রহস্য হলো এমন কিছু যা সম্পর্কে সঠিক কোনো ধারণা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। পৃথিবীতে রহস্যের শেষ নেই। আর এইসব রহস্য নিয়ে মানুষের কৌতুহলেরও শেষ নেই। আজও মানুষেরা অনেক রহস্যের কূলকিনারা খুজে পায় নি। অনেক কিছুর রহস্য আবিষ্কার করলেও অইসব জিনিসের ব্যাখ্যাও সঠিকভাবে দিতে পারে নি। যার কারনে আজও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র কিছু রহস্যের ব্যাখ্যা পাবার জন্য।
“এরিয়া ৫১” এমন ই একটি স্থান, যা সম্পর্কে সঠিক কোনো ধারনা নেই। যা নিয়ে মানুষ এর কৌতুহলেরও শেষ নেই। “এরিয়া ৫১” বহুল আলোচিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি। এটি নিয়ে ঠিক কবে থেকে আলোচনা শুরু হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। এরিয়া ৫১ এমন একটি স্থান যেখানকার ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সাধারন মানুষের চলাচল নিষেধ। দুর্ভেদ্য বেষ্টনীতে ঘেরা ঘাঁটিতে আজ পর্যন্ত বেসামরিক কেউ প্রবেশের দাবি করেনি। মার্কিন বিমান বাহিনি ঠিক কোন কারনে এই বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে তারও কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই।
ভিনগ্রহের প্রানী এলিয়েন নিয়ে মানুষ এর কৌতুহলের সীমা নেই। কিন্তু নানা ধরনের গুজব-গুঞ্জন তখনি ডালপালা মেলতে শুরু করে যখন শোনা গেলো মার্কিন গোপন বিমান ঘাঁটি “এরিয়া ৫১” নাকি ঘুরে গেছে এলিয়েন এর দল। ঘাঁটিটি থেকে অনেক উচ্চতায় নাকি অজ্ঞাত উরন্ত বস্তু “ইউএফও” এর দেখাও মিলেছে। এর পর থেকেই এ জায়গা আরো রহস্যময় হয়ে উঠে। কিন্তু এইসব কথাগুলো আদৌ সত্য কিনা তা নিয়েই সন্দেহের সীমা নেই। ধারনা করা হয় এখান থেকে এলিয়েনদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়।
সবচেয়ে রহস্যময় হলো এই জায়গাটুকু পৃথিবীর মানচিত্রে পাওয়া যায় নাহ এমনকি গুগল আর্থ এও নাই। আমেরিকার নেভাদা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাংশে লাস ভেগাস থেকে ১৩৩ কিলোমিটার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে গ্রুম হ্রদের দক্ষিনতীরে এরিয়া ৫১ এর অবস্থান। ২০১৩ সালে “সিআইএ” সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এরিয়া ৫১ এর কথা স্বীকার করে। ঠিক কবে থেকে মার্কিন এ গোপন ঘাঁটি “এরিয়া ৫১” নামে মানুষের নিকট পরিচিতি লাভ করে তা জানা যায় নি। অতীতের বিভিন্ন পত্রিকা, নথিপত্র ঘাটাঘাটি করে জানা যায়, পরীক্ষামুলকভাবে বিভিন্ন উড়োজাহাজ,ভারী অস্ত্র-শস্ত্র তৈরির কাজে এ ঘাঁটি ব্যবহার করা হয়। ২০০৯ সালে এরিয়া ৫১ থেকে অবসরপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা মানুষের কৌতুহল নিবারনের জন্য বলেছিলেন, এখানে মানবজাতির জন্য ক্ষতিকারক কিছুই করা হচ্ছে নাহ। নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যায়, অন্যান্য দেশের তুলনায় নিজেদের প্রযুক্তি উন্নত করার জন্য গবেষণার কাজগুলো অতি গোপনীয়তার সঙ্গে করা হচ্ছে। এখানে নাকি চন্দ্র মডিউল,সামরিক বিমান ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু কথাগুলো আদৌ সত্য না মিথ্যা তা বোঝার উপায় নেই।
কিন্তু যে গোপনীয়তার সহিত পুরো পৃথিবী হতে এলাকাটি নিশ্চিহ্ন করা তার কারনেই রহস্যের অন্ত নেই। নীল আর্মস্ট্রং এর চন্দ্র অভিযানের যে ইতিহাস, তাও নাকি পুরোটাই সাজানো একটি নাটক। এ নাটকের মঞ্চ হিসেবে নাকি ব্যবহৃত হয়েছিলো এরিয়া ৫১ নামের রহস্যঘেরা এ ঘাঁটির। আসলে অনেক খবর বের হয় এই এরিয়া ৫১ নিয়ে কিছু মিথ্যা কিছু সত্য, কিন্তু কোনগুলো মিথ্যা আর কোনগুলো সত্য তা না জানার কারনেই আজও এইসব রহস্যের জালে বন্দি।
এরিয়া ৫১ নিয়ে নানা গল্প শোনা যায়, সেগুলো রুপকথা না আদৌ ঘটেছে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। এরিয়া ৫১ নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্কের জন্ম হয় মানুষের চাঁদে যাওয়া নিয়ে। নীল আর্মস্ট্রং এর চন্দ্র অভিযানের যে ইতিহাস সেটা নাকি পুরোটাই একটি সাজানো নাটক। যে নাটকের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো এরিয়া ৫১।
অ্যাপোলো রকেট ডিজাইন করা কোম্পানি রকেটডাইন এর একজন ইঞ্জিনিয়ার ও পর্যবেক্ষক বিল কেইসিং এর লেখা “উই নেভার ওয়েন্ট টু দি মুন” শিরোনামের বইটি ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। এ বইয়ে লেখক দাবি করেন, অ্যাপোলো মিশন ছিলো বড় একটা মিথ্যা। পুরোটাই আইওয়াশ। তিনি নানা বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে প্রমান করার চেষ্টা করেন যে বাস্তবে ওই অভিযানের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। শুধুমাত্র বিল কেইসিং ই নন, আরো অনেকেই এই কথা বলেছেন। ষাটের দশকের নাসায় কর্মরত মহাকাশচারী এবং ও অ্যাপোলো মিশনের সায়েন্টিফিক এডভাইজার ‘ব্রাইয়ান ওলেরি’ বলেন, “আমি শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারছি না যে সত্যিই কি তাঁরা চাঁদে গিয়েছিলো”। সবচেয়ে বেশি মজার বিষয় হলো, খোদ আমেরিকার ২০ শতাংশ মানুষ নীল আর্মস্ট্রং এর চন্দ্র অভিযানের প্রচলিত গল্প বিশ্বাস করে না।
তাহলে এত দিন ধরে যা জেনে আসছিলাম, সেটার পুরোটাই কি একটি সাজানো গল্প? রহস্যের সমীকরণ খুঁজে পেতে চলুন ফিরে যাই চার দশক আগে, যখন আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে শীতল যুদ্ধ চলছিল। দুই দেশই তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছিল।
যু্দ্ধজয়ে মরিয়া দুই পক্ষই। তৎকালীন এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো যে, যে দেশ আগে মহাকাশে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে তারাই জয়ী হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর পৃথিবী থেকে প্রথম স্যাটেলাইট ‘স্পুটনিক ‘ মহাকাশে পাঠায়। মহাকাশে সোভিয়েত ইউনিয়নের এমন সাফল্য দেখে মাথাচারা দিয়ে উঠে আমেরিকা। বিল কেইসিং এর মতে ওই সময়ের প্রযুক্তিতে চাঁদে যাওয়া এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার সম্ভাবনা ০.০০১৭ শতাংশ। কিন্তু এই সোভিয়েত ইউনিয়নকে দমানোর জন্যই নাকি এই অ্যাপোলো মিশন।

কথা হলো গিয়ে, অ্যাপোলো মিশন যদি মিথ্যা হয় তাহলে আমেরিকা কিভাবে এত বড় মিথ্যাকে সত্যে রুপান্তরিত করে পৃথিবীতে প্রকাশ ঘটালো। বিল কেইসিং এর মতে, “অ্যাপোলো মিশনে মহাকাশযানগুলো মহাকাশে গিয়েছিলো। কিন্তু চাঁদে মানুষ পাঠানো হয় নাই। অ্যাপোলো-১১ মহাকাশযানটি ৮ দিন পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরেছিল। এরপর মুলযানটি আলাদা হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। আর টিভিতে যেটা দেখানো হয়েছিলো তা ছিলো পূর্বে ধারন করা। অনেকেই বলেন এটি ছিলো খুব বড় বাজেটের একটি নাটক যা এরিয়া ৫১ নামের মার্কিন গোপন ঘাঁটিতে মঞ্চায়িত হয়। এইসব কথাগুলোর পক্ষে যুক্তিরও অভাব নেই। কিন্তু কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তার কোন সঠিক তথ্য এখনো কেউ জানেনা ।
আগের দুই পর্ব থেকে আমরা জেনেছি যে এরিয়া ৫১ রহস্যের অন্তরালে থাকা একটি ঘাঁটি যা আমেরিকায় অবস্থিত। এখানে কি কাজ করা হয় এত গোপনীয়তা মান্য করে সেটার রহস্যই আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। রহস্যের ডামাঢোল বাজানোর যেই কারন তা হলো মানুষ আদৌ চাঁদে গিয়েছে কিনা? আর না গিয়ে থাকলে সেটার মঞ্চায়ন এরিয়া ৫১ তেই হয়েছে কিনা? আসলে নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রতেই এইসবের প্রমান পাওয়া যায় না। বিচার করতে হয় যুক্তি দিয়ে। আর যেহেতু একেকজনের যুক্তি একেকরকম, তাই রহস্য আজও বিদ্যমান।
১৯৭৭ সালের ২ জুন হলিউডে মুক্তি পায় ” কেপ্রিকন ১” নামের একটা ছবি। ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বাজেটের মুভিটির দৃশ্য আর চাঁদ থেকে পাঠানো মহাকাশচারীদের ভিডিওর সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। প্রযোজক পল এন ল্যাজারুসের মতে, নাসা ৪০ বিলিয়ন বাজেটের প্রোগ্রাম অ্যাপোলো মিশনে যে ভিডিও দেখিয়েছে, সেটা তারা মাত্র ৪ বিলিয়ন বাজেট নিয়ে করে দেখিয়েছে তাও আবার একটা টিভি স্টুডিও তে। আবার বিল কেইসিং এর মতেও চন্দ্র অভিযান হয় নি, এটাকে নাটকের আকারে সাজানো হয়েছে। আসলে সন্দেহের মুল কারন অনেক কিছুই আছে। যেমন,নাসার সরবরাহ করা ফুটেজে দেখা যায় দুটি বস্তুর ছায়া পরস্পরকে ছেদ করেছে।অথচ তা আলোর উৎস হওয়ায় সমান্তরাল হওয়ার কথা। এমনই হাজারো রহস্য আজও লুকিয়ে আছে। প্রমান করার জন্য যুক্তি অনেক উঠানো যায়, কিন্তু বিশ্বাস করার দায়িত্ব তো আপনার।
এরিয়া ৫১ এর অস্তিত্বের কথা স্বীকারঃ গত বছর সিআইএ একটি নথি উন্মুক্ত করে যার মধ্যে এরিয়া ৫১ এর কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবে সেখানে একটি কথা পরিষ্কার করা হয়েছে এবং তা হলো যে এরিয়া ৫১ এ ভিনগ্রহের প্রানীরা যাতায়াত করতো নাহ। বরং “ইউ-২” নামের গুপ্তচর বিমানের একটি প্রকল্প পরিচালনায় ব্যবহৃত হতো জায়গাটি। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নজরদারি করাই ছিলো যেটার মুল উদ্দেশ্য।
তথ্য অধিকার আইনের আওতায় সিআই এর কাছ থেকে এসব তথ্য পেয়েছে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় নিরাপত্তা মহাফেজখানা। ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশ করা ওই নথিতে বলা হয়, গোপন-গুপ্তচর বিমান এর পরীক্ষা নিরিক্ষার জন্য ১৯৫৫ সালে নেভাদার জনশূন্য মরুভুমিতে “এরিয়া ৫১” নামের বর্তমান এই জায়গাটি বেছে নেয়া হয়।
নথিতে বলা হয়, অতি উচ্চতায় তাদের এইসব গুপ্তচর বিমান ওড়ানোর ফলে একটি গুজব অতিদ্রুত ছড়িয়ে পরলো যে ভিনদেশি প্রানীরা নাকি আমেরিকা ঘুরে গেছে। আসলে হয়েছিল কি, তৎকালীন বানিজ্যিক বিমানগুলো সাধারনত ১০-২০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তো। বি-৪৭ মডেলের যুদ্ধবিমানগুলো উড়তো ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায়। কিন্তু সেখানে ‘ইউ-২’ বিমানগুলো উড়তে পারতো ৬০ হাজারফুট উপর দিয়ে, যার কারনে সাধারন মানুষের ধারনা করতে সময় লাগে নাই যে এটি সাধারন কোনো বিমান নয়, নিশ্চয়ই ভিনদেশ থেকে এসেছে। অতি গোপন এই প্রকল্পের কথা যাতে ফাঁস না হয় সেইকারনে তখন চুপ ছিলো সিআইএ। এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর হয়তো সামনেই বের হবে। যতই তারা এরিয়া ৫১ এর কথা স্বীকার করুক, সাধারণ মানুষ এর মনে আজও সন্দেহ জাগবে তাহলে এখন কি করা হচ্ছে এরিয়া ৫১ এ ? কেন আজও এত নিরাপত্তা দিয়ে ঘেরাও করা ওই এরিয়া ৫১? মনের মধ্যে প্রশ্ন উঠা সাধারন ব্যাপার, কিন্তু এইসব প্রশ্নের উত্তর যখন সারা পৃথিবীর মানুষের নিকটই অজানা থাকে তখনই তাকে সবচেয়ে রহস্যময় বলা যায়।
তথ্যসূত্র: বাংলা ইনিশিয়েটর
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন