জুজু কি ? প্রথমেই বলে রাখি, ‘জুজু’ শব্দটা বাংলা সাহিত্যে একটা বাগধারার মত ব্যবহৃত হয় । ইংরেজি bogus boo এর মতই বাংলায় জুজু শব্দটি কোনো একটা কাল্পনিক ভয়াবহ জিনিস বুঝাতে ব্যবহৃত হয় । ছোট বাচ্চাদের পানির কাছাকাছি/বিপজ্জনক কোনো জায়গায় যেতে সব মায়েরাই নিষেধ করেন । বাচ্চারা না শুনলে ইংল্যান্ডের মায়েরা তখন বলেন, ওখানে যেয়ো না, ওখানে বোগাস বু আছে । বোগাস শব্দের আভিধানিক অর্থই হচ্ছে মিথ্যা/ভুয়া । পানির কাছে ভৌতিক কিছু নেই আসলে । বাচ্চাটাকে নিরুতসাহিত করতেই ওর মা বোগাস বু নামক কাল্পনিক ভূতের ভয় দেখাচ্ছে।
বাংলা সাহিত্যেও জুজু সেই রকম কাল্পনিক ভূতের অর্থে ব্যবহৃত হয় । উদাহরন স্বরুপ জুজু শব্দের ব্যবহারকে আরো ভালো কর বোঝানোর জন্য কয়েকটি বাক্য তৈরি করে দেখাচ্ছি ।
১. ‘প্রতিবেশী দেশ নিয়ে পুরনো জুজুর গল্প শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে গেছে’
২. ‘ছোটবেলা থেকেই আপনার ভেতরে যদি জুজু ঢুকে যায় যে আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা,আমি ভাল ছাত্রনা—তাহলে সেই জুজু আপনি কাটাতে পারবেন না । জীবনে উন্নতি করার জন্য সবার আগে মন থেকে জুজু তাড়াতে হবে’
এখানে জুজু শব্দের ব্যাবহার ১নং বাক্যে মিথ্যা ও ২য় বাক্যে এ ভয় এর বিপরীত এ ব্যাবহার করা হয়েছে। আশা করি বাংলায় জুজু শব্দের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে আপনাদের ।
বাংলায় এই ‘সাহিত্যের জুজু’ বাদেও একটা ‘আক্ষরিক জুজু’ রয়েছে । জুজু মূলত এটা একটা আঞ্চলিক শব্দ । সিলেট এলাকার মানুষ জুজু নামের এক বিশেষ প্রকৃতির রহস্যময় প্রানীর কথা বলে থাকেন । বাংলাদেশের অন্য এলাকায় এই ধরনের জুজুর কথা শোনা যায়না । মোটামুটি যা জানা যায় তা হল -জুজু লোমশ একটা জীব । এর চোখ লাল টকটকে । ছোট বাচ্চাদের দিকেই এর নজর বেশী ।
রেডিও ফুর্তির ভূত এফ এম নামক প্রোগ্রামে সিলেট চা বাগানের এক লোক এসেছিলেন একবার । জুজুকে নিয়ে তিনি যা যা শুনেছেন তাই শেয়ার করেছিলেন । ভূত এফ এম এ বর্ননা করা গল্প থেকে জানতে যায় –
এক মহিলা তার বাচ্চা কে ঘুম পাড়িয়ে আরেক রূমে টিভি দেখতে চলে গেল । কাজের মেয়েটা বাচ্চার রূমে এসেই গলা ফাটিয়ে একটা চিত্কার দিল । মহিলা দৌড়ে রূমে এসে দেখলেন কাজের মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে , আর লোমশ একটা জীব বাচ্চাটাকে জানালা দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে । বাচ্চাটা হাত পা ছোড়াছুড়ি করছিল । মহিলাকে দেখেই জীবটা বাচ্চাটাকে ফেলে লাফ দিয়ে চা বাগানের ভিতর হারিয়ে যায় । জুজু ব্যাপারে আরেকটা ঘটনায় জানা যায়, এক বাচ্চা কোন কারণে খাবার খেতে চাইছিলনা । তার মা তাকে জোর করে খাওয়াতে চেষ্টা করছিলেন । এক পর্যায়ে মহিলা বললেন ,” তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও । না হলে জুজু আসবে ।” কাছেই একটা চা বাগান থেকে একটা শব্দ মহিলা শুনতে পেলেন , “জুজু আসবে ।” মহিলা এটাকে পাত্তা দিলেন না । মনের ভূল কথাটা উড়িয়ে দিলেন । খানিক পর বাচ্চাটা আবার বাহানা শুরু করলে মহিলা বিরক্ত হয়ে বললেন , “এই খাও বলছি । জুজু আসবে কিন্তু বলে দিলাম ।” এবার মহিলা আগের বারের মতই কিন্তু অনেক কাছে শব্দ শুনলেন যে ,” জুজু এসেছে !” মহিলা ভয় পেয়ে গেলেন । ব্যাপারটা তার স্বামীকে বলার জন্য বাচ্চাটাকে ডাইনিং রুমে বসিয়ে অন্য রুমে গেলেন । তিনি যখনই তার স্বামীকে শব্দের ব্যাপারটা বলছিলেন , হঠাত্ তারা দুজনই শেষ বারের মত শব্দটা শুনলেন । এইবার শব্দটা ছিল এরকম : “জুজু খাচ্ছে !” “জুজু খাচ্ছে !” তারা দৌড়ে ডাইনিং রুমে গেলেন । গিয়ে দেখলেন , কালো লোমশ একটা প্রাণী জানালা দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে । আর তাদের বাচ্চা ? বাচ্চাটাকে অর্ধেক খেয়ে ফেলা হয়েছে ! জুজু নিয়ে চা বাগানের এটাই সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনা । চা বাগানে প্রায়ই কাজ করার সময় ছোট ছোট বাচ্চা নিখোঁজ হয় । পরে তাদের মাথা কাটা লাশ পাওয়া যায় । কার কাজ কেউই জানে না।
বন্ধুরা আজ আমরা জুজু সর্ম্পকে সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানব-
আমরা আমাদের আশেপাশে যে কোনো প্রানীর অনেক গুলো প্রজাতিকেই দেখতে পাই ।প্রতিটা প্রজাতি একে অপরের থেকে একটু আলাদা । বিজ্ঞানীরা প্রতিটা আলাদা প্রজাতির জন্য আলাদা আলাদা বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছেন । এইভাবে এদেরকে একে অপর থেকে সহজে আলাদা করা যায় । উদাহরন হিসবে আমরা প্যাচার কথা বলতে পারি ।বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির প্যাচা রয়েছে । এগুলো হল-হুতুম প্যাঁচা (Bubo bengalensis), ভূতুম প্যাঁচা (Ketupa zeylonensis), লক্ষ্মীপ্যাঁচা (Tyto alba), খুঁড়ুলে প্যাঁচা (Athene brama), কুপোখ (Ninox scutulata), নিমপোখ (Otus lepiji)। কোবরা সাপ আছে ১০ প্রজাতির। আর কুকুর,বিড়াল কিংবা কবুতরের প্রজাতি হিসাব করতে গেলে সেটি কয়েক শততে পৌছাবে ।
তবে এইখানে ‘প্রজাতি’র সংজ্ঞা একটু পরিষ্কার হয়ে নেওয়া ভাল । প্রজাতি হচ্ছে জীব জগতের শ্রেনীবিন্যাসের সেই সর্বনিম্ন শ্রেনী ,যেখানে জীবেরা একে অপরের সাথে যৌন মিলন করে একই প্রজাতির অপর একটি fertile (সন্তান জন্ম দিতে পারবে এমন) সন্তান জন্ম দিতে পারে । ২ টা পাতি কাক একে অপরের সাথে মিলনের মাধ্যমে নতুন একটা পাতি কাক জন্ম দিতে পারবে, কিন্তু দাড় কাকের সাথে পাতি কাকের মিলনে কোন বাচ্চা হবেনা ,কারন পাতি কাক আর দাড় কাকের প্রজাতি আলাদা । তবে কখনো কখনো ২ টা আলাদা প্রজাতির মিলনে সন্তান হতে পারে, তবে সেই সন্তান fertile হয়না । সেই নতুন বাচ্চা থেকে আর কোনো নতুন বাচ্চা হয়না । যেমন-ঘোড়া আর গাধার মিলনে খচ্চর জন্ম নেয় । রুই মাছ আর কাতল মাছের মিলনে জন্মায় কালিবাউশ মাছ । খচ্চর বা কালিবাউশ, এদের কারোরই সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নেই কারন এরা আলাদা প্রজাতির বাবা-মা থেকে এসেছে ।
আমাদের আশেপাশের প্রতিটি প্রানীরই একাধিক প্রজাতি রয়েছে ।কিন্তু মানুষের প্রজাতি কয়টা ? কখনো চিন্তা করেছেন বিষয়টা ? ঠিক ধরেছেন, মানুষ এর একটাই প্রজাতি আছে পৃথিবীতে আর সেটাই হলাম আমরা। Homo sapiens । বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হয়না ? মানুষের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অন্যান্য প্রজাতি থাকার কথা না পৃথিবীতে ? বিজ্ঞানীরা বলছেন,অতীতে হোমো স্যাপিয়েন্সের মতই মানুষের আরো কয়েকটা প্রজাতি পৃথিবীতে ছিল । ২ মিলিয়ন বছর আগে Homo ergester ছিল পৃথিবীতে । ১ মিলিয়ন বছর আগেও Homo erectus ছিল , Homo antecessor নামে আরেকটা প্রজাতিও ছিল সেই সময়ে । Homo sapiens এসেছে মোটামুটি ৩ লাখ বছর আগে । ওই সময়ে পৃথিবীতে একই সময়ে জাভা মানব, পিকিং মানব, নিয়ানডারথাল মানবরাও ঘুরে বেড়াত (Homo rhodesiensis, Homo erectus , Homo neanderthalensis)। ধারনা করা হয় হোমো সাপিয়েন্স এর সাথে যুদ্ধ করে বাকি প্রজাতিগুলো পরাজিত হয়েছে । হোমো স্যাপিয়েন্স তাদেরকে পুরোপুরিই মেরে ফেলেছে । মানুষের ওই প্রজাতিগূলোর কোনো এক পিসও এখন আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই । তাদের এক জনকেও আমরা খুজে বের করতে পারিনি । তবে বিশ্বের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় মাঝে মাঝে মানুষের আকৃতির কিছু প্রানী দেখা যায় । এরা প্রায় মানুষের মতই আচরন করে । এমনকি মানুষের গলায় কথাও বলতে পারে মাঝে মাঝে । ধারনা করা হয় এরা মানুষের পরাজিত প্রজাতির অবশিষ্ট প্রানীরা । নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে এরা দুর্গম এলাকায় থাকে। মাঝে মাঝে এক্সিডেন্টালি মানুষের সামনে পড়ে যায় ।
হিমালয়ের তুষারমানব ইয়েতি কে সন্দেহ করা হয় সম্ভাব্য হোমো ইরেকটাস এর বেঁচে যাওয়া বংশধর হিসেবে । খেয়াল রাখবেন, হিমালয় আর সিলেটের পাহাড় কিন্তু একই পাহাড়শ্রেনীর অংশ । আমাদের জুজুর গল্পে যে জিনিসটা চোখে পড়ার মত সেটা হল জুজু মানুষের গলায় কথা বলতে পারে এবং জুজু ২ পায়ে মানুষের মত চলতে পারে । হতেও পারে এরা কোনো Homo প্রজাতির বংশধর । সেক্ষত্রে প্রশ্ন আসে , কেন তারা শুধু বাচ্চাদের এটাক করে ? বড় মানুষদের এতাক করে না কেন ? সম্ভবত বড় মানুষদের তারা ভয় পায় । শক্তিতে বা বুদ্ধিতে তারা এডাল্ট মানুষদের সাথে পারবে না বলেই তারা মানুষদের কাছ থেকে দূরে থাকে । তবে শিশুদের কাছ থেকে বিপদের ভয় নেই বলেই হয়তো জুজুরা শিশু ধরে খেতে চায় । এটা জাস্ট একটা হাইপোথিসিস বা সম্ভাব্য বিশ্লেষন । বিস্তারিত অনুসন্ধান ছাড়া কিছু বলা যাবেনা । এমনও হতে পারে চা বাগানের কোনো মা তার পিতৃ পরিচয় বিহীন ছেলেকে নিজেই খুন করে/গ্রাম থেকে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য জুজুর গল্প তৈরি করেছিল, এবং কালক্রমে সেটাই কিংবদন্তীতে পরিনত হয়ে গেছে । কোনো নিরেট প্রমান ছাড়া কোন সিদ্ধান্তে আসা যাবেনা । এই বিষয়ে আরো তথ্য দরকার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন