শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬

অপেক্ষা

সেবার পূর্নিমায় গ্রামের বাড়ি ছিলাম। প্রতিবারের মত
এবারো জ্যোৎস্না উৎসবের কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ
ঠিক করলাম মাইল পাঁচেক দূরের দেড়শো বছর
পুরানো রহস্যময় হিন্দু রাজবাড়িতে যাব। ওখানে নাকি
পূর্নিমা উৎসব হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। শেষ
বিকালের দিকে রওনা হয়ে গেলাম। কিন্তু পথে
বাস ড্রাইভার বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। আমাকে
এই সন্ধ্যায় অমন শ্মশানঘাটে যেতে মানা করল।
এমনিতে তো ঐ এলাকায় কেউ যায় না তার উপর
অপরিচিত! শুনে তো আমার আত্মারাম খাচাছাড়া! এ
যুগে আবার এ কেমনকথা ? ভাবলাম এই রাতে আর
ওদিকে যাবোই না। বাসথেকে নেমেই আবার
ফিরতি গাড়িতে ফিরে আসব। বাস থেকে নেমে
যখন রাজবাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালাম খুবই অবাক হলাম।
আসলেই ওখানে পূর্নিমা উৎসব চলছে। মেয়েরা
দলে দলে পড়েছে রঙ বেরঙের শাড়ি আর
খোপায় গাদা ফুলের মালা। সাজ সাজ রব দেখে
ভয় কবেই দৌড়ে পালিয়েছে বুঝতেই পারিনি।
আমিও নির্ভয়ে বসে পড়লামতাদের সাথে।
আসরের মধ্যমনি একটি যুবতী মেয়েসাদা শাড়ি
আর খোপায় শিউলিমালা পরেছে। কি অপূর্ব মিল!
দেখলেই কেমন একটা স্নিগ্ধতা জাগে।
মেয়েটি হারমোনিয়ামে কি সুন্দর গান তুলছে।
আহা! এমনই এক রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীকেই
তো আজীবন নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে
কল্পনা করে এসেছি! শুধু তাই নয়। সুরের মুর্ছনায়
কখন যে মধ্যরাত পেরিয়ে গেছেবুঝতেই
পারিনি। শেষের দিকে একজন প্রৌঢ়া সুরতুলছিল।
তখন সেই শিউলিমালার যুবতীটি আমার কাছাকাছি
এসে বসেছিল। আমারও খুব ইচ্ছা হল কথা বলার ।
আমার অভ্যাসমত শুরুটা করলাম খোচা দিয়েই “কি
ব্যাপার? এত মহাসজ্জার দিনে বিধবার সাদা শাড়ি!”
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো, “বিধবাই তো!”
যদিও কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। তাও কথা
চালিয়ে নিলাম। নাম তার শুভ্রতা দেবী। (দেখতে
দেবীর মতই। আরপোষাকেও শুভ্রতারছোয়া।)
থাকেন এক অজানা গায়ে যেখানে মানবের
পদধূলি পড়ে না! (কথার কি ঢং!) অনেকটা সময় যাওয়ার
পর বুঝতে পারলাম তার প্রতিটি হেয়ালীর একটা
অর্থ আছে। তার গহীন মনে কোথাও ব্যথা
আছে। সে আনমনে তার কথাই বলে। আমার নামটা
পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে না। তাও তার প্রতি আগ্রহ
বাড়তে থাকল। আমি তার কাছে আরো গান শুনতে
চাইলাম সেও আমায় শোনাল আমার পছন্দের
গানগুলো। ‘ভালবাসি ভালবাসি’, ‘তুমি কোন কাননের
ফুল’, ‘আমার এই ঝরনা তলার নির্জনে’,‘এসেছিলে
তবু কেন আসোনি’, ‘আমারও পরান যাহা চায়’
আরো কত গান। কি আবেগ, কি মমতা দিয়েই না
গেয়েছিল। তার আবেগ আমাকেওছুয়ে
গিয়েছিল। গান শেষ হওয়ার পরও আমরা
অনেকক্ষন নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম।
অবশেষে আমিই নীরবতা ভাঙলাম। ‘অসাধারন! আমি
আর কখনো সরাসরি এত ভাল গান শুনিনি।’ ‘তুমি কি
আমার একটা উপকার করবে?’ হঠাৎ কথার প্রসঙ্গ
বদলে যাওয়ায় থতমত খেলাম। তাও বললাম
‘অবশ্যই। বলো কি করতে হবে?’ ‘তুমি ঢাকায়
গেলে আমার কিছু চিঠি কোন একটা
পোস্টবাক্সে পোস্ট করে দিতে পারবে?’
‘ও,এই ব্যাপার! এ আর এমন কি?! লিখে দিও। নিয়ে
যাব।’ ‘লেখা আছে। এই যে।’ বলে আমাকে কিছু
হলুদ খাম বাড়িয়ে দিল। ‘কিসের চিঠি এগুলো? এই
মোবাইল, ফেসবুকের যুগে চিঠি কেন?!’
কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ‘দয়া করে
কোন কিছু জিজ্ঞেস না করলে খুশি হব।’ আমিও
আর কিছুজিজ্ঞেস করলাম না। তখনও বুঝিনি কি
সর্বনাশ করতে চলেছি আমি। এর দুদিন পর ঢাকায়
ফিরে তিনটি চিঠি পোস্ট করে দিলাম। তার তিন দিন
পরেই পেলাম ভয়াবহ দুঃসংবাদগুলো। তিনটি বিভৎস
মৃত্যু। না শুধু মৃত্যু নয়। অপঘাতে মৃত্যু! একটি লাশ
পাওয়া যায় দিঘীর পাড়ে উলটাহয়ে ঝুলে আছে।
ঘাড় পেছন দিকে বাঁকানো। ২য় লাশটি পাওয়া যায়
ঘরের সিলিং থেকে ফায়ারপ্লেসের উপর কাত
হয়ে আছে; শরীরের অর্ধেক আগুনে
ঝলসানো। ৩য় লাশটি সিড়ি ঘরে উলটে পড়েছিল;
ঘাড় থেকে মাথা আলাদা, চোখ উল্টে আছে।
বোঝাই যাচ্ছে, তিনজনই খুব কষ্ট পেয়ে মারা
গেছে। লাশের বিভৎসতা দেখে গ্রামবাসীরা
পর্যন্ত কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। আমি গ্রামের
এক বৃদ্ধ প্রবীনের কাছেশুনি রাজবাড়ির ইতিহাস। ১৩
বছর বয়সে এই রাজবাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল
শুভ্রতা দেবী। বাসর রাতেই প্রচন্ড ভেদবমিতে
স্বামী মারা যায়! গ্রামবাসী বলছিল, কি সর্বনাশী
মেয়ে গো! বাসর রাতেই স্বামী হরন! এ তো
মেয়ে নয়,সাক্ষাত রাক্ষসী! তার ভাগ্য যে
তাকে স্বামীর চিতায় পোড়ানো হয়নি। তারও
ব্যবস্থা হয়েছিল। শুভ্রতার ৭ বছরের ছোট ভাই
আর বিধবা মায়ের কারনে তা সম্ভব হয়নি। এর শাস্তি
স্বরুপ শুভ্রতার সামনেই সেই বালক শিশুটিকে
গাছের সাথে বেধে প্রহার করা হলো। অত:পর
গ্রাম হতে নির্বাসন। আর শুভ্রতা?? এই পাপের
প্রাসাদে বন্দী করা হয় আর চালানো হয় অমানুষিক
নির্যাতন। এর থেকে মুক্তির জন্য আত্মহত্যার পথ
বেছে নেয়। কিন্তু,তাতে তার দেহটাই মুক্তি পায়।
তার নির্যাতিত অশান্ত আত্মাটা এই রাজবাড়ির সীমানায়
বন্দী হয়ে থাকে। ঘুরতে থাকে
প্রতিশোধের নেশায়। এই রাজবাড়ির সীমানায়
অনেক ঘরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বাকিরা গ্রাম
ছেড়ে পালায়। জমিদারবাড়ির সবাইকেই নির্মমভাবে
শেষ করে। কিন্তু এই বাড়ির তিনটি ছেলে ঢাকায়
চলে যায়। তারাই শুভ্রতাকে বেশি নির্যাতন
করেছিল। তাদের জন্য জন্যই এত বছরের
প্রতীক্ষা। আত্মা রাজবাড়ির সীমানার বাইরে
যেতে পারত না। তাই চিঠি দিয়ে তাদের এখানে
ডেকে আনে। তাদের আজ নিশ্চিহ্ন করে মুক্তি
পেল শুভ্রতাদেবীর অশান্ত আত্মা। আমি হতবাক
হয়ে শুনি আর ভাবি। কখনো নিজেকে অপরাধী
ভাবি। কখনো বা ভাবি আমি এক মজলুম বন্দিনীর
মুক্তির প্রদীপ। সবকিছু ছাপিয়ে যখন শুভ্রতার সে
নির্মল মুখটা ভেসে ওঠে, তার সে সুরেলা
গানেরকলতান মনে পড়ে তখন নিজেকে সকল
পাপের উর্ধ্বে মনে হয়। গ্রামবাসী এখন ঐ
বাড়ির নাম শুনলেও চমকে ওঠে।কিন্তু আমি
এখনো একা রাজবাড়ির সে শ্মশানঘাটে গিয়ে
বসে থাকি, রাজবাড়ির পাশে বয়ে চলা নদীর পাড়
ধরে হেটে চলি নির্ভয়ে।এমনকি পূর্নিমা রাতেও
যাই শুভ্রতার জন্যই। ইশ, অন্তত একবারও যদি দেখা
দিত তাহলে বলতাম এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে
অন্ততএকজন হলেও আছে যে তোমাকে তার
সমগ্র সত্ত্বা দিয়ে অনুভব করে, যে তোমার
দেখা পাওয়ার জন্য বার বার ফিরে ফিরে আসে এই
জনমানবহীন গায়ে।

প্রকাশক: Pisach (পিশাচ) A ghost story

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন