ঢাকা শহরে অল্পদিনের নোটিসে বাসা খুজে
পাওয়া খুব কঠিন। তারপরও কিভাবে কিভাবে যেন
ম্যানেজ হয়ে গেল। অবশ্য বাসা একটু ছোট আর মূল
সড়ক থেকে ভিতরের দিকে। গলিটাও ভাঙাচোড়া,
গর্তে ভর্তি। এদিকটায় এখনো দু’একটা বদ্ধ ডোবা
চোখে পড়ে। আশে পাশে উচু দালান-কোঠা কম।
আমাদের ফ্ল্যাটটা পাঁচতলায় হওয়ায় আশে-পাশের
কোলাহল, ধূলাবালি একটু কমই লাগে। বেশ
নিরিবিলি। আমার এমনই পছন্দ। একাকী-নিরিবিলি
থাকতেই আমার ভাল লাগে।
ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়ার নেশা। এখন
আরো ভাল করে বই পড়া যাবে। আমাদের বিয়ে
হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। বাবা-মাকে ছেড়ে
ঢাকায় আসতে প্রথমে খুব খারাপ লাগলেও এখন
লাগছে না। এমন ছোট্ট, নিরিবিলি, ছিমছাম
সংসারই আমি মনে মনে চাইতাম। উনি অফিসে চলে
গেলে আমিতো একাই! নিজের মত করে ঘর-দোর
সাজানো যাবে।
এই বাড়িটা বেশ পুরোনো মনে হচ্ছে। স্থান স্থান
ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছিল। সেগুলো
পরিষ্কার করতে কষ্ট হয়েছে খুব। এখনও মাঝে
মাঝে পড়ে। বিছানা-মেঝে ময়লা হয়ে যায়। উনি
বলেছেন, আপাতত এই বাসায় থাকব আমরা। আরেকটু
ভাল বাসা পেলেই সেখানে যেয়ে উঠব।
বাসার মধ্যে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল
বেডরুমের দেয়ালে লাগানো প্রমাণ সাইজ আয়না।
লম্বায় মনে হয় পাঁচ ফিটের কম হবে না। পাশেও
প্রায় দুই ফিট। আয়নার কাঁচের চারপাশে আবার
কারুকার্যখচিত কাঠের ফ্রেম লাগানো। অনেকটা
রাজা-বাদশাদের ঘরে যেমন দেখা যায় সিনেমায়।
উপরের অংশে কাঠের মধ্যে ডায়মন্ড আকৃতির
একটা ফাঁক। দেখে মনে হয় কিছু একটা ছিল ওর
মধ্যে। এত বড় আয়না দিয়ে কি হত, কেনইবা এই
আয়না তৈরি করা হয়েছিল- কে জানে!
দিনকাল ভালই চলছিল। মাঝখানে গোলমাল করে
দিল দেয়াল আলমারিটা। জিনিসপত্র আলমারীতে
রাখতে হবে। ধূলাবালি ঝাড়তে যেয়ে কিসের যেন
টুং করে আওয়াজ হল। তাকিয়ে দেখি লাল একটা
পাথর। এত্ত সুন্দর! আমি হাতে নিলাম। হাতে নিতেই
পাথরটা যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠল। আমি সম্মোহিত
হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানি মনে হল পাথরটা
আমাকে কিছু বলতে চায়!
একটু পরেই মাথায় আসল পাথরটাতো অবিকল
আয়নার ঐ ফাঁকের মত। তাহলে কি ওটা ওখানেই
ছিল? ওখানে থাকলে খুলে রাখল কে? কেন রাখল?
সাতপাচঁ ভাবতে ভাবতে আমি আয়নাটার সামনে
দাড়ালাম। ঐতো আমাকে দেখা যাচ্ছে। পাথর
হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এগিয়ে গিয়ে ড্রয়িং
রুম থেকে ছোট একটা চেয়ার নিয়ে আসলাম।
তারপর ঐ চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে পাথরটা কাঠের
ফ্রেমের ঐ গর্তে ঢুকিয়ে দিলাম। সাথে সাথে মনে
হল আয়না হালকা একটু ঝাকি খেল। আমি অবাক
হয়ে গেলাম। আঙুলে দিয়ে পাথরটা বের করতে
চাইলাম। কি আশ্চর্য্য! পাথরটা বের হচ্ছে না।
মনেহচ্ছে পাথরটার চারপাশের কাঠের দেয়াল
পাথরটাকে চেপে ধরে রেখেছে।
একটু টানা হেচড়া করতেই পাথরটার খসখসে একটা
কোন আঙুলের মাথায় লেগে আঙুল কেটে গেল।
“উহ!!!”
মুখ দিয়ে অস্ফুষ্টে বেড়িয়ে এল। আঙুলের মাথায়
রক্তবিন্দু দেখতে পেলাম। পাথরটাতেও লেগেছে।
পাথরটা লাগা রক্তবিন্দুটা আমার চোখের সামনে
পাথরের মধ্যে হারিয়ে গেল। পাথরটা যেন রক্ত
শুষে নিল। আমার অবাক হবার ক্ষমতাও হারিয়ে
গেছে। আমি চেয়ার থেকে নেমে ধপ করে
বিছানায় বসে পড়লাম।
এই ছোট্ট ঘরে এই প্রথম আমার একটু ভয় ভয় করতে
লাগল। আয়নাটার দিকে তাকিয়ে মনে হল আয়নাটা
আগের চেয়ে উজ্জ্বল লাগছে। মনেহচ্ছে আয়নার
ভেতরের কেউ একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি রান্না ঘরে চলে আসলাম। বেডরুম, ডাইনিং,
কিচেন আর একটা বাথরুম নিয়ে আমার রাজত্ব।
বেডরুমের পাশের বারান্দাটা খুব সুন্দর। রাতের
বেলা ঠান্ডা হাওয়া আসে। শীত শীত লাগে।
এঘর ওঘর ঘুরতে ঘুরতে আমার প্রচন্ড নিঃসঙ্গ
লাগতে শুরু করল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে উনাকে
মেসেজ পাঠালাম একটা।
“আপনি আজকে একটু জলদি আসতে পারবেন?”
উনি খুব ছোট্ট করে রিপ্লে দিলেন, “আচ্ছা।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটায়
তিনি চলে এলেন। দরজা খুলে উনার চিন্তিত মুখ
দেখে মনে অন্যরকম এক ভাললাগার তৈরি হল।
“কি ব্যাপার? কি হয়েছে?”
“আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। তারপর বলছি।”
উনি ফ্রেশ হতে হতে আমি চট করে দু’কাপ চা করে
ফেললাম। চায়ের কাপ উনার হাতে দিয়ে সবকিছু
খুলে বললাম। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা
শুনলেন। বিশ্বাস করলেন কিনা বোঝা গেল না।
“চলতো দেখি।”
বেডরুমে যেয়ে উনি খুব খুটিয়ে খুটিয়ে আয়নাটা
দেখতে লাগলেন। ধাক্কা দিয়ে সরাতেও চাইলেন।
আয়না সরানো গেল না। পুরনো বাড়িতে অনেক
গোপন ব্যাপার-স্যাপার থাকেস; এমনটা বইয়ে,
টিভিতে অনেক সময় পাওয়া যায়। গোপন কুঠুরী,
গোপন সুইচ-তন্ন তন্ন করে খুজেও তেমন কিছু পাওয়া
গেল না।
“হয়ত তোমার মনের ভুল। সারাদিন বাসায় একা একা
থাকো। এমন হতেই পারে। তারপরও যদি তোমার এমন
কিছু আবারও মনে হয় তবে বলো। আয়নাটা সরানোর
ব্যবস্থা করতে হবে।”
এরপর সারাদিন আমার আমার অনেক আনন্দে কাটল।
বিকেল বেলা ঘুরতে বের হলাম। উনি অনেক গল্প
করলেন আমার সাথে। আমিও টুকটাক কথা বলতে
লাগলাম। ধীরে ধীরে মানুষটার সঙ্গ আমার কাছে
উপভোগ্য হয়ে উঠছে। আমি নিজেকে মেলে ধরতে
শুরু করেছি। জীবনটা বড় সুন্দর লাগছে।
রাতের খাবার আমরা বাইরেই খেলাম। বিকেলে এত
ঘুরাঘুরির পর শরীর অনেক ক্লান্ত হলেও ঘুম আসতে
চাইল না। আজকে ঠান্ডা একটু বেশি লাগছে। উঠে
গিয়ে বারান্দায় যাবার দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
আবার এসে শুয়ে পড়লাম। অস্থির অস্থির লাগছে।
কেন? এমন লাগবে কেন? চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে
চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ করে কিসের যেন খসখস শব্দে আমার কান
খাড়া হয়ে গেল। চোখ না খুলেই কান পাতলাম।
কিছু শোনা যায় কিনা! কিছু শোনা যাচ্ছে না।
দেহে ঢিল দিয়ে যখন মনেহল চোখের পাতা ভারী
হয়ে আসছে তখন আবার কি যেন শুনলাম। আবারো
কানপেতে রইলাম। এবার আর অপেক্ষা করতে হল
না। আবারো শুনলাম।
“পাআআআরুউউউউউল্ল্ল!”
কে যেন মোলায়েম গলায় আমার নাম ধরে ডাকছে।
কন্ঠটাও পরিচিত পরিচিত লাগছে। আয়নাটার
দিকে তাকালাম। আবারো কেউ ডাকল,
“পাআআরুউউউউউল্ল্ল”
এবার আমার মনে হল ডাকটা আয়নার ভেতর থেকে
আসছে। ভয়ে আমার হাত-পা পেটের ভিতর
সেধিয়ে যেতে লাগল। আমি উনাকে পিঠের উপর
দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। উনি সজাগ হয়ে গেলেন।
পাশ ফিরে বললেন,
“কি হয়েছে?”
“কিছু না, কিছু না।”
উনি বোধহয় বুঝতে পারলেন আমি ভয় পেয়ছি। হাত
বাড়িয়ে আমাকে আরো কাছে টেনে নিলেন।
উনার বুকের মধ্যে মাথা রেখে একসময় আমি ঘুমিয়ে
পড়লাম।
*******************
সকালবেলা রাতের কথা মনে হতে আমার হাসি
পেতে লাগল। আপনমনে ঘরের কাজ করতে লাগলাম।
একটু একটু করে গোছাই। পছন্দ হয় না। আবার নতুন
করে গোছাই। দশটার দিকে দরজায় কড়া নাড়ার
শব্দে চমকে উঠলাম। এই সময় আবার কে এল!!
দরজা খুলে একটা হাসিখুশি মুখ চোখে পড়ল। ২৮-৩০
বছরের এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে অবাক
হয়ে তাকাতে দেখে মৃদু হাসি দিয়ে বললেন,
“আপনি নিশ্চয়ই এ বাসার ভাবি? আমি আপনাদের
উপরের ফ্ল্যাটে থাকি। আপনাদের সাথে পরিচিত
হতে এসেছি। কি, ভিতরে আসতে বলবেন না?”
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আসুন, আসুন।
খুব খুশি হলাম আপনি এসেছেন। আসলে আমারই
যাওয়ার দরকার ছিল। বাসা এখনো গুছিয়ে উঠতে
পারি নি। তাই যাওয়া হয় নি। কোথায় যে
আপনাকে একটু বসতে দেই!!”
“না, না। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমিও তাই
ভেবেছিলাম যে হয়ত এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেন
নি। প্রথম প্রথম অনেক ঝামেলা হয়। কোন হেল্প
লাগে কিনা সেটাও দেখতে এলাম।”
“খুব ভাল লাগল ভাবি।”-উনার আন্তরিকতায়
আসলেই আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কথা বলতে বলতে
উনাকে নিয়ে আমি শোবার ঘরে চলে আসলাম।
“ভাবি চা করে আনি?”
“চা করবেন? ঠিক আছে। আমি কিন্তু রঙ চা খাই।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি এখানেই বসুন। আমি
আসছি।”
চা নিয়ে এসে দেখি উনি আয়নাটার সামনে
দাঁড়িয়ে আছেন।
“আপনাদের আয়নাটা খুব সুন্দর।”- চা নিতে নিতে
উনি বললেন।
“হুম!”
“আপনার বুঝি চায়ের খুব তৃষ্ণা? আমারো। আমি
রাত-বিরেতেও চা খাই। আপনাকেও কাল রাতে
বারান্দায় চা খেতে দেখলাম…”
“আমাকে?” আমিতো অবাক। “কালরাতে? কখন?”
“এইতো বারোটার দিকে…”
“ভাবি মনেহয় ভুল দেখেছেন।
“কি যে বলেন, ভুল দেখব কেন? নাকি আপনাদের
এখানে আরো কেউ আছে?”
“জ্বী না ভাবি। আমি আর আপনার ভাই ছাড়া আর
কেউ নেই। আর কালকে আমরা সারাদিন ঘোরাঘুরি
করেছি। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। এসেই ঘুমিয়ে
পড়েছি।”
“তাই?!!” শীলা ভাবির গলায় অবিশ্বাস! ওহ, বলতে
ভুলেই গিয়েছি। ভাবি তার নাম বলেছেন শীলা।
“তাহলে হয়ত আমারই ভুল হয়েছে।” বলার ভঙ্গিতে
বোঝা গেল মুখে বললেও তিনি মনে মনে মেনে
নিতে পারছেন না। তবে এ ব্যাপারে আর কিছু
বললেন না।
“ঠিক আছে ভাবি। আজকে তাহলে উঠি। আরেকদিন
আসব। আপনিও আমাদের বাসায় আসবেন সময় করে।
আমি একা এসেছি। আপনি ভাইকে নিয় আসবেন।”
“আচ্ছা।” আমি হেসে ফেললাম। “আপনিও আবার
আসবেন। সারাদিনতো একাই থাকি। আপনি আসলে
ভাল লাগবে।”
শীলা ভাবি চলে গেলেন। আমি ঘরের কাজকর্ম
সামলাতে লাগলাম।
উনি আজকেও একটু আগে ফিরলেন। সঙ্গে মধ্যবয়স্ক
এক মহিলা।
“আগে থেকেই খুজছিলাম। আজকে পেয়ে গেলাম।
উনি আজ থেকে আমাদের সাথেই থাকবেন। ঘরের
কাজকর্মে তোমাকে সাহায্য করবেন।”
ভালই হল। সারাদিন একা একা থাকতে আর কত ভাল
লাগে! আমি খালাকে ঘরের কাজকর্ম বুঝিয়ে
দিতে লাগলাম। খালা কাজকর্মে বেশ পটু মনে হল।
কথাও কম বলেন। রাতে বেলা ডাইনিং রুমে
বিছানা করে শুয়ে পারবে বলে জানিয়ে দিলাম।
সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘরে একটা
মোমবাতিই ছিল। খালাকে বললাম জালিয়ে
শোবার ঘরে দিয়ে যেতে। এর মধ্যে উনি আবার
বের হলেন। আরো কয়েকটা মোমাবাতি নিয়ে
আসবেন। বিদ্যুতের কথা বলা যায় না। কখন ফিরে
কে জানে।
মোমবাতি নিয়ে খালা যখন শোবার ঘরে ঢুকলেন
তখন আমি বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আমার দিকে চোখে পড়তেই খালা চমকে উঠলেন।
হালকা চিৎকার দিলেন। মোমবাতিটা তার হাত
থেকে পড়ে গেল। একছুটে বেড়িয়ে গেলেন। তার
চিৎকার শুনে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু আসে
পাশে তাকিয়ে কিছুই দেখলাম না। খালার পিছু
পিছু আমিও বের হয়ে এলাম।
খালার আচরনে আমি খুব অবাক হলাম। খালা
রান্নাঘরে ঢুকে ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে
দিয়েছেন। আমার বিস্ময় আকাশে পৌছল যখন
ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ পেলাম। বেশ
কয়েকবার ডাকার পরও সে যখন সাড়া দিল না তখন
শোবার ঘরে এসে গুম হয়ে বসে রইলাম।
একটু পরে আম সচকিত হয়ে উঠলাম। মনেহল কে যেন
আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখছে। আর
ঘরটাও একদম শীতল হয়ে গিয়েছে। গ্রীষ্মকাল,
বৃষ্টির নাম-গন্ধও নেই। অথচ ঘরের ভিতর শীতকালের
আবহাওয়া।। আয়নাটার দিকে তাকালাম। অদ্ভূত
একটা আভা বের হচ্ছে আয়নাটা থেকে। শীতে,
ভয়ে শরীর কেঁপে উঠল। আমি বিছানা থেকে নেমে
ডাইনিং রুমে আসতেই কলিং বেলের শব্দ পাওয়া
গেল।
উনি বোধহয় এসেছেন দরজা খুলে দিতেই বিদ্যুৎ
চলে আসল। আমি ফ্যাকাসেভাবে হাসার চেষ্টা
করলাম। আমার নিষ্প্রাণ হাসি উনার চোখ এড়াল
না।
“কি হয়েছে?”
আমি সবকিছু খুলে বললাম। উনি যেয়ে রান্নাঘরের
দরজায় নক করে খালাকে ডাক দিলেন। কিছুক্ষন
ডাকাডাকি করার পর খালা দরজা খুলেই বললেন,
“আমি আর এই বাসায় কাম করুম না।”
“কেন? কি হয়েছে?”
“কিছু হয় নাই। আমি কাম করতে পারুম না।”
খালার গলা শুনেই বোঝা গেল এই ব্যাপারে তার
সাথে কথা বলে আর লাভ হবে না। উনি খালাকে
অন্তত আজরাতটা থেকে যেতে রাজি করালেন।
আসলেই এই রাতের বেলা কোথায় যাবেন!
রাতে ভাল ঘুম হল না। ছেড়ে ছেড়ে দুঃস্বপ্ন
দেখতে লাগলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমি ঘুমিয়ে
আছি। আমিই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলছি।
মাঝখানে শীতে একবার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবার এসে শুয়ে
পড়লাম।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল।
উঠে দেখি উনি অফিসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছেন।
আমাকে উঠতে দেখে বললেন,
“ঘুম ভাঙল? খালা চলে গেছেন। তোমাকে ঘুমাতে
দেখে আমি আর ডাকলাম না। আজকে নাহয় বাইরেই
নাস্তা করে নেব।”
একটু হেসে উনি বেরিয়ে গেলেন।
*********************
বাসা থেকে হেসে বিদায় নিলেও রিয়াদ মনে মনে
খুব চিন্তিত। কি যে হচ্ছে এসব! বিয়ে করেছে এই
সেদিন। বউটাও খুব ভাল। কিন্তু এ কি ধরনের
ঝামেলা! কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নিচে নামতেই
গেটের দাড়োয়ানের সাথে দেখা।
“স্যার, ম্যাডামের কি হয়েছে?”
“কি হয়েছে মানে? কি হবে?”
“না, সকাল বেলা আপনাদের বাসার কাজের বুয়া
চলে যাবার সময় আমার সাথে একটু কথা হয়েছে।
কি বলল, মাথামুন্ডু কিছু বুঝলাম না।”
“কি বলেছে?”
“না স্যার, আপনি রাগ করবেন।”
“না, রাগ করব না। বলে ফেলো।”
“না মানে স্যার, বুয়া বলল, ম্যাডাম নাকি মানুষ
না, জ্বীন! ম্যাডামের নাকি ছায়া নাই।”
“কি নেই!!!”
“ছায়া নেই স্যার, ছায়া! এই দেখেন স্যার আপনার
কত বড় ছায়া। আপনারটার পাশে আমার ছায়া।
ম্যাডামের নাকি ছায়া নাই!!!???”
দাড়োয়ানের কথা শুনে রিয়াদ স্তম্ভিত হয়ে গেল।
কি আশ্চর্য্য! ছায়া থাকবে না কেন? এটা কোন
কথা!
দুঃশ্চিন্তা নিয়ে রিয়াদ গেট থেকে বেরোতে
যেয়েও থেমে গেল। আবার সিড়ি ভেঙ্গে উপরে
উঠতে শুরু করল।
রিয়াদকে আবার ফিরে আসতে দেখে পারুল খুব
অবাক হল।
“আমার কিছু কাগজপত্র ফেলে গিয়েছি।”- রিয়াদ
অপ্রস্তুত।
পারুল হেসে ফেলল। দরজা ছেড়ে দিয়ে ভিতরে
ঢুকে গেল। রিয়াদ বেডরুমে ঢুকে শুধুই এটা-ওটা
উলটে পালটে দেখতে লাগল।
“পারুল এদিকে এসো তো।”
ডাক শুনে পারুল বেডরুমে আসল। হাতে টুথপেস্ট আর
ব্রাশ।
“আমি কি দোষ করেছি? আমাকে মারবে কেন?” “দোষ! না তুমি কোন দোষ করনি। তুমি আমাকে জীবিত করেছো। ঐ পাথরটাই আমার প্রাণ। আয়নাতে তুমি পাথরটাতে লাগানোর সাথে সাথে আমি জীবন্ত হই। আর তোমার ছায়া আয়নাতে আটকে যায়। আর সেই ছায়াতে ভর করে অভিশাপ। এখন সেই অভিশাপের বলি হবে তুমি। আর তোমার জায়গায় সংসার করব আমি!” “আমাকে মেরো না।” পারুলের গলায় কান্নার সুর। “আমি চলে যাব। তুমি সংসার করো। আমি আর কোনদিন ফিরে আসব না।” “তোমাকে হত্যার না করা পর্যন্ত আমি পূর্ণতা পাব না। এবার প্রস্তুত হও।” বলেই ছায়াটা শাড়ির আঁচল গলায় পেচাতে লাগল। তীব্র ভয় নিয়ে পারুল দেখল তার শাড়ির আঁচলটাও তার গলায় পেচিয়ে গেল। পারুল আঁচল খামচে ধরে গলা থেকে সরিয়ে দিতে চাইল। কোন লাভ হল না। বরং একটু পরেই আঁচলটা গলায় চেপে বসতে শুরু করল। অক্সিজেনের জন্য পারুলে ফুসফুস হাঁসফাস করে উঠল। পারুল বুঝতে পারল মৃত্যু আর বেশি দূরে নেই। এরই মধ্যে অক্সিজেনের অভাবে চোখের সামনে লাল-নীল বাতি জ্বলে উঠতে শুরু করছে। দুর্বল হয়ে পারুল মেঝেতে পড়ে গেল। তাই দেখে ছায়ামূর্তি আরো জোড়ে হেসে উঠল। পারুল মেঝেতে পড়তেই শক্ত, গোলগাল কি যেন হাতে লাগল। পেপার ওয়েট! হাতের মুঠোতে নিয়েই পারুল শরীরের বাকিশক্তিটুকু দিয়ে পেপার ওয়েট টা আয়নার দিকে ছুড়ে মারল। ঝনঝন শব্দের সাথে সাথেই পারুল জ্ঞান হারাল। ************ পাঁচ বছর পর! পারুলরা এখন ভালই আছে। এই পাঁচবছরে পারুলে দু’টো সন্তান হয়েছে। দুটোই ছেলে। বড়টার বয়স তিন আর ছোটটার বয়স এক। দু’জনের দুষ্টুমি সামলাতে সামলাতেই পারুলের দিন চলে যায়। সেই পুরনো বাসা রিয়াদ ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। দুইপুত্র-স্ত্রী নিয়ে সে সুখেই আছে। তবে পারুলের মুখের দিকে তাকালে একটা খটকা তার সবসময়ই লাগে। অনেক ভেবে-চিন্তেও রিয়াদ কোন কূল-কিনারা করতে পারে না। পারুলের বাঁ গালের তিলটা কিভাবে ডান গালে এল? গত পাঁচটি বছর ধরে ভেবেও রিয়াদ কোন যোক্তিক উত্তর খুজে পায়নি। হতাশ হয়ে রিয়াদ ভাবে, জগতের কিছু রহস্য রহস্যই থেকে যায়। কখনই উদঘাটন হয় না! কিছু রহস্য থাক না গোপন!!
পারুল যেন বুঝতে না পারে এমনভাবে রিয়াদ পারুলের চারপাশে ঘুরতে লাগল। “কি খোজেন?” “ন্ না, কিছু না।” রিয়াদের গলায় ভয়। পারুল অবাক হয়ে গেল। “আমি যাই।” বলেই রিয়াদ হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেল। এরপর সারাদিন আর পারুলের সময় কাটেনা। সকালের ঘটনাটা নিয়ে অনেক ভেবেছে। কিছুই বুঝতে পারছে না কেন রিয়াদ ওমন করল! দুপুরের দিকে আকাশ কালো হয়ে এল। বৃষ্টি হল খুব। বৃষ্টি দেখে পারুল আনমনা হয়ে গেল। ইস! এখন যদি উনি থাকতেন। একসাথে ভেজা যেত! বিকেলের দিকে রিয়াদ ফোনে জানালেন যে, আজকে তার ফিরতে দেরি হবে। অফিসে জরুরী মিটিং আছে। পারুলের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেল। মোমবাতি জ্বালিয়ে একা একা বসে থাকতে কার ভাল লাগে? পারুলেরও লাগছে। দু-একবার মোবাইলটা হাতে নিয়েও রেখে দিয়েছে। রিয়াদকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছিল। পরে বিরক্ত করা হবে ভেবে আর দেয়া হয়নি। পারুল হঠাৎ খেয়াল করল ঘরটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। মোমবাতির আলোটাও কেমন নিভু নিভু হয়ে আসছে। পারুলের গাঁ শিরশির করে উঠল। মনের ভিতর ভয়টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। “পারুউউউল্ল!” – কে যেন ফিসফিসিয়ে উঠল। “ক্বে..কে?” – পারুলের গলা কেঁপে গেল। “আমিইইহহ…” “আমি কে?” “তুমি আর আমিতো একই।” এবার পারুল কন্ঠস্বরের উৎসটা বুঝতে পারল। কথাগুলো আয়নার ভিতর থেকে আসছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে আয়নাটার দিকে এগিয়ে গেল। ঐতো পারুলকে দেখা যাচ্ছে। কে কথা বলে!!??? আয়নার ভিতরের ছায়াটা হঠাৎ নড়ে উঠল। পারুল চমকে গেল। সেতো নড়ে নি। ছায়াটা নড়ল কিভাবে?!! ছায়াটা আরো এগিয়ে আসতে লাগল। পারুল ভয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। পারুলের চোখের সামনে ছায়াটা আয়না থেকে বেড়িয়ে এল। পারুল পিছু হটতে হটতে দেয়ালের সাথে সেঁটে গেল। “কে তুমি?” “হি হি…ভয় পাচ্ছো কেন? তুমি আর আমিতো একই।” “না না…তুমি আয়না থেকে বেড়োলে কি করে?” “এটা একটা অভিশপ্ত আয়না। অনেককাল আগে এক রাজকন্যার খুব প্রিয় আয়না ছিল এটি। সেই রাজ্যের রাজা পাশের রাজ্যের রাজার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন। রাজকন্যার ঘরের এই আয়নাটি রাজার খুব পছন্দ হয়। আয়নাটা সরিয়ে নিতে চাইলে রাজকন্যা রাজার সৈন্যদের বাধা দেয়। তখন এক সৈন্য তাকে হত্যা করে। মারা যাবার আগে রাজকন্যা অভিশাপ দিয়ে যায়, এই আয়না যার কাছে থাকবে সে-ই ধ্বংস হয়ে যাবে। যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হবে তার! হা হা…! আজকেই তোমার শেষ দিন।
লিখেছেন:আহমাদ রবিন
পাওয়া খুব কঠিন। তারপরও কিভাবে কিভাবে যেন
ম্যানেজ হয়ে গেল। অবশ্য বাসা একটু ছোট আর মূল
সড়ক থেকে ভিতরের দিকে। গলিটাও ভাঙাচোড়া,
গর্তে ভর্তি। এদিকটায় এখনো দু’একটা বদ্ধ ডোবা
চোখে পড়ে। আশে পাশে উচু দালান-কোঠা কম।
আমাদের ফ্ল্যাটটা পাঁচতলায় হওয়ায় আশে-পাশের
কোলাহল, ধূলাবালি একটু কমই লাগে। বেশ
নিরিবিলি। আমার এমনই পছন্দ। একাকী-নিরিবিলি
থাকতেই আমার ভাল লাগে।
ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়ার নেশা। এখন
আরো ভাল করে বই পড়া যাবে। আমাদের বিয়ে
হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। বাবা-মাকে ছেড়ে
ঢাকায় আসতে প্রথমে খুব খারাপ লাগলেও এখন
লাগছে না। এমন ছোট্ট, নিরিবিলি, ছিমছাম
সংসারই আমি মনে মনে চাইতাম। উনি অফিসে চলে
গেলে আমিতো একাই! নিজের মত করে ঘর-দোর
সাজানো যাবে।
এই বাড়িটা বেশ পুরোনো মনে হচ্ছে। স্থান স্থান
ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছিল। সেগুলো
পরিষ্কার করতে কষ্ট হয়েছে খুব। এখনও মাঝে
মাঝে পড়ে। বিছানা-মেঝে ময়লা হয়ে যায়। উনি
বলেছেন, আপাতত এই বাসায় থাকব আমরা। আরেকটু
ভাল বাসা পেলেই সেখানে যেয়ে উঠব।
বাসার মধ্যে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল
বেডরুমের দেয়ালে লাগানো প্রমাণ সাইজ আয়না।
লম্বায় মনে হয় পাঁচ ফিটের কম হবে না। পাশেও
প্রায় দুই ফিট। আয়নার কাঁচের চারপাশে আবার
কারুকার্যখচিত কাঠের ফ্রেম লাগানো। অনেকটা
রাজা-বাদশাদের ঘরে যেমন দেখা যায় সিনেমায়।
উপরের অংশে কাঠের মধ্যে ডায়মন্ড আকৃতির
একটা ফাঁক। দেখে মনে হয় কিছু একটা ছিল ওর
মধ্যে। এত বড় আয়না দিয়ে কি হত, কেনইবা এই
আয়না তৈরি করা হয়েছিল- কে জানে!
দিনকাল ভালই চলছিল। মাঝখানে গোলমাল করে
দিল দেয়াল আলমারিটা। জিনিসপত্র আলমারীতে
রাখতে হবে। ধূলাবালি ঝাড়তে যেয়ে কিসের যেন
টুং করে আওয়াজ হল। তাকিয়ে দেখি লাল একটা
পাথর। এত্ত সুন্দর! আমি হাতে নিলাম। হাতে নিতেই
পাথরটা যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠল। আমি সম্মোহিত
হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানি মনে হল পাথরটা
আমাকে কিছু বলতে চায়!
একটু পরেই মাথায় আসল পাথরটাতো অবিকল
আয়নার ঐ ফাঁকের মত। তাহলে কি ওটা ওখানেই
ছিল? ওখানে থাকলে খুলে রাখল কে? কেন রাখল?
সাতপাচঁ ভাবতে ভাবতে আমি আয়নাটার সামনে
দাড়ালাম। ঐতো আমাকে দেখা যাচ্ছে। পাথর
হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এগিয়ে গিয়ে ড্রয়িং
রুম থেকে ছোট একটা চেয়ার নিয়ে আসলাম।
তারপর ঐ চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে পাথরটা কাঠের
ফ্রেমের ঐ গর্তে ঢুকিয়ে দিলাম। সাথে সাথে মনে
হল আয়না হালকা একটু ঝাকি খেল। আমি অবাক
হয়ে গেলাম। আঙুলে দিয়ে পাথরটা বের করতে
চাইলাম। কি আশ্চর্য্য! পাথরটা বের হচ্ছে না।
মনেহচ্ছে পাথরটার চারপাশের কাঠের দেয়াল
পাথরটাকে চেপে ধরে রেখেছে।
একটু টানা হেচড়া করতেই পাথরটার খসখসে একটা
কোন আঙুলের মাথায় লেগে আঙুল কেটে গেল।
“উহ!!!”
মুখ দিয়ে অস্ফুষ্টে বেড়িয়ে এল। আঙুলের মাথায়
রক্তবিন্দু দেখতে পেলাম। পাথরটাতেও লেগেছে।
পাথরটা লাগা রক্তবিন্দুটা আমার চোখের সামনে
পাথরের মধ্যে হারিয়ে গেল। পাথরটা যেন রক্ত
শুষে নিল। আমার অবাক হবার ক্ষমতাও হারিয়ে
গেছে। আমি চেয়ার থেকে নেমে ধপ করে
বিছানায় বসে পড়লাম।
এই ছোট্ট ঘরে এই প্রথম আমার একটু ভয় ভয় করতে
লাগল। আয়নাটার দিকে তাকিয়ে মনে হল আয়নাটা
আগের চেয়ে উজ্জ্বল লাগছে। মনেহচ্ছে আয়নার
ভেতরের কেউ একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি রান্না ঘরে চলে আসলাম। বেডরুম, ডাইনিং,
কিচেন আর একটা বাথরুম নিয়ে আমার রাজত্ব।
বেডরুমের পাশের বারান্দাটা খুব সুন্দর। রাতের
বেলা ঠান্ডা হাওয়া আসে। শীত শীত লাগে।
এঘর ওঘর ঘুরতে ঘুরতে আমার প্রচন্ড নিঃসঙ্গ
লাগতে শুরু করল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে উনাকে
মেসেজ পাঠালাম একটা।
“আপনি আজকে একটু জলদি আসতে পারবেন?”
উনি খুব ছোট্ট করে রিপ্লে দিলেন, “আচ্ছা।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটায়
তিনি চলে এলেন। দরজা খুলে উনার চিন্তিত মুখ
দেখে মনে অন্যরকম এক ভাললাগার তৈরি হল।
“কি ব্যাপার? কি হয়েছে?”
“আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। তারপর বলছি।”
উনি ফ্রেশ হতে হতে আমি চট করে দু’কাপ চা করে
ফেললাম। চায়ের কাপ উনার হাতে দিয়ে সবকিছু
খুলে বললাম। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা
শুনলেন। বিশ্বাস করলেন কিনা বোঝা গেল না।
“চলতো দেখি।”
বেডরুমে যেয়ে উনি খুব খুটিয়ে খুটিয়ে আয়নাটা
দেখতে লাগলেন। ধাক্কা দিয়ে সরাতেও চাইলেন।
আয়না সরানো গেল না। পুরনো বাড়িতে অনেক
গোপন ব্যাপার-স্যাপার থাকেস; এমনটা বইয়ে,
টিভিতে অনেক সময় পাওয়া যায়। গোপন কুঠুরী,
গোপন সুইচ-তন্ন তন্ন করে খুজেও তেমন কিছু পাওয়া
গেল না।
“হয়ত তোমার মনের ভুল। সারাদিন বাসায় একা একা
থাকো। এমন হতেই পারে। তারপরও যদি তোমার এমন
কিছু আবারও মনে হয় তবে বলো। আয়নাটা সরানোর
ব্যবস্থা করতে হবে।”
এরপর সারাদিন আমার আমার অনেক আনন্দে কাটল।
বিকেল বেলা ঘুরতে বের হলাম। উনি অনেক গল্প
করলেন আমার সাথে। আমিও টুকটাক কথা বলতে
লাগলাম। ধীরে ধীরে মানুষটার সঙ্গ আমার কাছে
উপভোগ্য হয়ে উঠছে। আমি নিজেকে মেলে ধরতে
শুরু করেছি। জীবনটা বড় সুন্দর লাগছে।
রাতের খাবার আমরা বাইরেই খেলাম। বিকেলে এত
ঘুরাঘুরির পর শরীর অনেক ক্লান্ত হলেও ঘুম আসতে
চাইল না। আজকে ঠান্ডা একটু বেশি লাগছে। উঠে
গিয়ে বারান্দায় যাবার দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
আবার এসে শুয়ে পড়লাম। অস্থির অস্থির লাগছে।
কেন? এমন লাগবে কেন? চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে
চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ করে কিসের যেন খসখস শব্দে আমার কান
খাড়া হয়ে গেল। চোখ না খুলেই কান পাতলাম।
কিছু শোনা যায় কিনা! কিছু শোনা যাচ্ছে না।
দেহে ঢিল দিয়ে যখন মনেহল চোখের পাতা ভারী
হয়ে আসছে তখন আবার কি যেন শুনলাম। আবারো
কানপেতে রইলাম। এবার আর অপেক্ষা করতে হল
না। আবারো শুনলাম।
“পাআআআরুউউউউউল্ল্ল!”
কে যেন মোলায়েম গলায় আমার নাম ধরে ডাকছে।
কন্ঠটাও পরিচিত পরিচিত লাগছে। আয়নাটার
দিকে তাকালাম। আবারো কেউ ডাকল,
“পাআআরুউউউউউল্ল্ল”
এবার আমার মনে হল ডাকটা আয়নার ভেতর থেকে
আসছে। ভয়ে আমার হাত-পা পেটের ভিতর
সেধিয়ে যেতে লাগল। আমি উনাকে পিঠের উপর
দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। উনি সজাগ হয়ে গেলেন।
পাশ ফিরে বললেন,
“কি হয়েছে?”
“কিছু না, কিছু না।”
উনি বোধহয় বুঝতে পারলেন আমি ভয় পেয়ছি। হাত
বাড়িয়ে আমাকে আরো কাছে টেনে নিলেন।
উনার বুকের মধ্যে মাথা রেখে একসময় আমি ঘুমিয়ে
পড়লাম।
*******************
সকালবেলা রাতের কথা মনে হতে আমার হাসি
পেতে লাগল। আপনমনে ঘরের কাজ করতে লাগলাম।
একটু একটু করে গোছাই। পছন্দ হয় না। আবার নতুন
করে গোছাই। দশটার দিকে দরজায় কড়া নাড়ার
শব্দে চমকে উঠলাম। এই সময় আবার কে এল!!
দরজা খুলে একটা হাসিখুশি মুখ চোখে পড়ল। ২৮-৩০
বছরের এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে অবাক
হয়ে তাকাতে দেখে মৃদু হাসি দিয়ে বললেন,
“আপনি নিশ্চয়ই এ বাসার ভাবি? আমি আপনাদের
উপরের ফ্ল্যাটে থাকি। আপনাদের সাথে পরিচিত
হতে এসেছি। কি, ভিতরে আসতে বলবেন না?”
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আসুন, আসুন।
খুব খুশি হলাম আপনি এসেছেন। আসলে আমারই
যাওয়ার দরকার ছিল। বাসা এখনো গুছিয়ে উঠতে
পারি নি। তাই যাওয়া হয় নি। কোথায় যে
আপনাকে একটু বসতে দেই!!”
“না, না। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমিও তাই
ভেবেছিলাম যে হয়ত এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেন
নি। প্রথম প্রথম অনেক ঝামেলা হয়। কোন হেল্প
লাগে কিনা সেটাও দেখতে এলাম।”
“খুব ভাল লাগল ভাবি।”-উনার আন্তরিকতায়
আসলেই আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কথা বলতে বলতে
উনাকে নিয়ে আমি শোবার ঘরে চলে আসলাম।
“ভাবি চা করে আনি?”
“চা করবেন? ঠিক আছে। আমি কিন্তু রঙ চা খাই।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি এখানেই বসুন। আমি
আসছি।”
চা নিয়ে এসে দেখি উনি আয়নাটার সামনে
দাঁড়িয়ে আছেন।
“আপনাদের আয়নাটা খুব সুন্দর।”- চা নিতে নিতে
উনি বললেন।
“হুম!”
“আপনার বুঝি চায়ের খুব তৃষ্ণা? আমারো। আমি
রাত-বিরেতেও চা খাই। আপনাকেও কাল রাতে
বারান্দায় চা খেতে দেখলাম…”
“আমাকে?” আমিতো অবাক। “কালরাতে? কখন?”
“এইতো বারোটার দিকে…”
“ভাবি মনেহয় ভুল দেখেছেন।
“কি যে বলেন, ভুল দেখব কেন? নাকি আপনাদের
এখানে আরো কেউ আছে?”
“জ্বী না ভাবি। আমি আর আপনার ভাই ছাড়া আর
কেউ নেই। আর কালকে আমরা সারাদিন ঘোরাঘুরি
করেছি। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। এসেই ঘুমিয়ে
পড়েছি।”
“তাই?!!” শীলা ভাবির গলায় অবিশ্বাস! ওহ, বলতে
ভুলেই গিয়েছি। ভাবি তার নাম বলেছেন শীলা।
“তাহলে হয়ত আমারই ভুল হয়েছে।” বলার ভঙ্গিতে
বোঝা গেল মুখে বললেও তিনি মনে মনে মেনে
নিতে পারছেন না। তবে এ ব্যাপারে আর কিছু
বললেন না।
“ঠিক আছে ভাবি। আজকে তাহলে উঠি। আরেকদিন
আসব। আপনিও আমাদের বাসায় আসবেন সময় করে।
আমি একা এসেছি। আপনি ভাইকে নিয় আসবেন।”
“আচ্ছা।” আমি হেসে ফেললাম। “আপনিও আবার
আসবেন। সারাদিনতো একাই থাকি। আপনি আসলে
ভাল লাগবে।”
শীলা ভাবি চলে গেলেন। আমি ঘরের কাজকর্ম
সামলাতে লাগলাম।
উনি আজকেও একটু আগে ফিরলেন। সঙ্গে মধ্যবয়স্ক
এক মহিলা।
“আগে থেকেই খুজছিলাম। আজকে পেয়ে গেলাম।
উনি আজ থেকে আমাদের সাথেই থাকবেন। ঘরের
কাজকর্মে তোমাকে সাহায্য করবেন।”
ভালই হল। সারাদিন একা একা থাকতে আর কত ভাল
লাগে! আমি খালাকে ঘরের কাজকর্ম বুঝিয়ে
দিতে লাগলাম। খালা কাজকর্মে বেশ পটু মনে হল।
কথাও কম বলেন। রাতে বেলা ডাইনিং রুমে
বিছানা করে শুয়ে পারবে বলে জানিয়ে দিলাম।
সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘরে একটা
মোমবাতিই ছিল। খালাকে বললাম জালিয়ে
শোবার ঘরে দিয়ে যেতে। এর মধ্যে উনি আবার
বের হলেন। আরো কয়েকটা মোমাবাতি নিয়ে
আসবেন। বিদ্যুতের কথা বলা যায় না। কখন ফিরে
কে জানে।
মোমবাতি নিয়ে খালা যখন শোবার ঘরে ঢুকলেন
তখন আমি বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আমার দিকে চোখে পড়তেই খালা চমকে উঠলেন।
হালকা চিৎকার দিলেন। মোমবাতিটা তার হাত
থেকে পড়ে গেল। একছুটে বেড়িয়ে গেলেন। তার
চিৎকার শুনে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু আসে
পাশে তাকিয়ে কিছুই দেখলাম না। খালার পিছু
পিছু আমিও বের হয়ে এলাম।
খালার আচরনে আমি খুব অবাক হলাম। খালা
রান্নাঘরে ঢুকে ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে
দিয়েছেন। আমার বিস্ময় আকাশে পৌছল যখন
ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ পেলাম। বেশ
কয়েকবার ডাকার পরও সে যখন সাড়া দিল না তখন
শোবার ঘরে এসে গুম হয়ে বসে রইলাম।
একটু পরে আম সচকিত হয়ে উঠলাম। মনেহল কে যেন
আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখছে। আর
ঘরটাও একদম শীতল হয়ে গিয়েছে। গ্রীষ্মকাল,
বৃষ্টির নাম-গন্ধও নেই। অথচ ঘরের ভিতর শীতকালের
আবহাওয়া।। আয়নাটার দিকে তাকালাম। অদ্ভূত
একটা আভা বের হচ্ছে আয়নাটা থেকে। শীতে,
ভয়ে শরীর কেঁপে উঠল। আমি বিছানা থেকে নেমে
ডাইনিং রুমে আসতেই কলিং বেলের শব্দ পাওয়া
গেল।
উনি বোধহয় এসেছেন দরজা খুলে দিতেই বিদ্যুৎ
চলে আসল। আমি ফ্যাকাসেভাবে হাসার চেষ্টা
করলাম। আমার নিষ্প্রাণ হাসি উনার চোখ এড়াল
না।
“কি হয়েছে?”
আমি সবকিছু খুলে বললাম। উনি যেয়ে রান্নাঘরের
দরজায় নক করে খালাকে ডাক দিলেন। কিছুক্ষন
ডাকাডাকি করার পর খালা দরজা খুলেই বললেন,
“আমি আর এই বাসায় কাম করুম না।”
“কেন? কি হয়েছে?”
“কিছু হয় নাই। আমি কাম করতে পারুম না।”
খালার গলা শুনেই বোঝা গেল এই ব্যাপারে তার
সাথে কথা বলে আর লাভ হবে না। উনি খালাকে
অন্তত আজরাতটা থেকে যেতে রাজি করালেন।
আসলেই এই রাতের বেলা কোথায় যাবেন!
রাতে ভাল ঘুম হল না। ছেড়ে ছেড়ে দুঃস্বপ্ন
দেখতে লাগলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমি ঘুমিয়ে
আছি। আমিই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলছি।
মাঝখানে শীতে একবার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবার এসে শুয়ে
পড়লাম।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল।
উঠে দেখি উনি অফিসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছেন।
আমাকে উঠতে দেখে বললেন,
“ঘুম ভাঙল? খালা চলে গেছেন। তোমাকে ঘুমাতে
দেখে আমি আর ডাকলাম না। আজকে নাহয় বাইরেই
নাস্তা করে নেব।”
একটু হেসে উনি বেরিয়ে গেলেন।
*********************
বাসা থেকে হেসে বিদায় নিলেও রিয়াদ মনে মনে
খুব চিন্তিত। কি যে হচ্ছে এসব! বিয়ে করেছে এই
সেদিন। বউটাও খুব ভাল। কিন্তু এ কি ধরনের
ঝামেলা! কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নিচে নামতেই
গেটের দাড়োয়ানের সাথে দেখা।
“স্যার, ম্যাডামের কি হয়েছে?”
“কি হয়েছে মানে? কি হবে?”
“না, সকাল বেলা আপনাদের বাসার কাজের বুয়া
চলে যাবার সময় আমার সাথে একটু কথা হয়েছে।
কি বলল, মাথামুন্ডু কিছু বুঝলাম না।”
“কি বলেছে?”
“না স্যার, আপনি রাগ করবেন।”
“না, রাগ করব না। বলে ফেলো।”
“না মানে স্যার, বুয়া বলল, ম্যাডাম নাকি মানুষ
না, জ্বীন! ম্যাডামের নাকি ছায়া নাই।”
“কি নেই!!!”
“ছায়া নেই স্যার, ছায়া! এই দেখেন স্যার আপনার
কত বড় ছায়া। আপনারটার পাশে আমার ছায়া।
ম্যাডামের নাকি ছায়া নাই!!!???”
দাড়োয়ানের কথা শুনে রিয়াদ স্তম্ভিত হয়ে গেল।
কি আশ্চর্য্য! ছায়া থাকবে না কেন? এটা কোন
কথা!
দুঃশ্চিন্তা নিয়ে রিয়াদ গেট থেকে বেরোতে
যেয়েও থেমে গেল। আবার সিড়ি ভেঙ্গে উপরে
উঠতে শুরু করল।
রিয়াদকে আবার ফিরে আসতে দেখে পারুল খুব
অবাক হল।
“আমার কিছু কাগজপত্র ফেলে গিয়েছি।”- রিয়াদ
অপ্রস্তুত।
পারুল হেসে ফেলল। দরজা ছেড়ে দিয়ে ভিতরে
ঢুকে গেল। রিয়াদ বেডরুমে ঢুকে শুধুই এটা-ওটা
উলটে পালটে দেখতে লাগল।
“পারুল এদিকে এসো তো।”
ডাক শুনে পারুল বেডরুমে আসল। হাতে টুথপেস্ট আর
ব্রাশ।
“আমি কি দোষ করেছি? আমাকে মারবে কেন?” “দোষ! না তুমি কোন দোষ করনি। তুমি আমাকে জীবিত করেছো। ঐ পাথরটাই আমার প্রাণ। আয়নাতে তুমি পাথরটাতে লাগানোর সাথে সাথে আমি জীবন্ত হই। আর তোমার ছায়া আয়নাতে আটকে যায়। আর সেই ছায়াতে ভর করে অভিশাপ। এখন সেই অভিশাপের বলি হবে তুমি। আর তোমার জায়গায় সংসার করব আমি!” “আমাকে মেরো না।” পারুলের গলায় কান্নার সুর। “আমি চলে যাব। তুমি সংসার করো। আমি আর কোনদিন ফিরে আসব না।” “তোমাকে হত্যার না করা পর্যন্ত আমি পূর্ণতা পাব না। এবার প্রস্তুত হও।” বলেই ছায়াটা শাড়ির আঁচল গলায় পেচাতে লাগল। তীব্র ভয় নিয়ে পারুল দেখল তার শাড়ির আঁচলটাও তার গলায় পেচিয়ে গেল। পারুল আঁচল খামচে ধরে গলা থেকে সরিয়ে দিতে চাইল। কোন লাভ হল না। বরং একটু পরেই আঁচলটা গলায় চেপে বসতে শুরু করল। অক্সিজেনের জন্য পারুলে ফুসফুস হাঁসফাস করে উঠল। পারুল বুঝতে পারল মৃত্যু আর বেশি দূরে নেই। এরই মধ্যে অক্সিজেনের অভাবে চোখের সামনে লাল-নীল বাতি জ্বলে উঠতে শুরু করছে। দুর্বল হয়ে পারুল মেঝেতে পড়ে গেল। তাই দেখে ছায়ামূর্তি আরো জোড়ে হেসে উঠল। পারুল মেঝেতে পড়তেই শক্ত, গোলগাল কি যেন হাতে লাগল। পেপার ওয়েট! হাতের মুঠোতে নিয়েই পারুল শরীরের বাকিশক্তিটুকু দিয়ে পেপার ওয়েট টা আয়নার দিকে ছুড়ে মারল। ঝনঝন শব্দের সাথে সাথেই পারুল জ্ঞান হারাল। ************ পাঁচ বছর পর! পারুলরা এখন ভালই আছে। এই পাঁচবছরে পারুলে দু’টো সন্তান হয়েছে। দুটোই ছেলে। বড়টার বয়স তিন আর ছোটটার বয়স এক। দু’জনের দুষ্টুমি সামলাতে সামলাতেই পারুলের দিন চলে যায়। সেই পুরনো বাসা রিয়াদ ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। দুইপুত্র-স্ত্রী নিয়ে সে সুখেই আছে। তবে পারুলের মুখের দিকে তাকালে একটা খটকা তার সবসময়ই লাগে। অনেক ভেবে-চিন্তেও রিয়াদ কোন কূল-কিনারা করতে পারে না। পারুলের বাঁ গালের তিলটা কিভাবে ডান গালে এল? গত পাঁচটি বছর ধরে ভেবেও রিয়াদ কোন যোক্তিক উত্তর খুজে পায়নি। হতাশ হয়ে রিয়াদ ভাবে, জগতের কিছু রহস্য রহস্যই থেকে যায়। কখনই উদঘাটন হয় না! কিছু রহস্য থাক না গোপন!!
পারুল যেন বুঝতে না পারে এমনভাবে রিয়াদ পারুলের চারপাশে ঘুরতে লাগল। “কি খোজেন?” “ন্ না, কিছু না।” রিয়াদের গলায় ভয়। পারুল অবাক হয়ে গেল। “আমি যাই।” বলেই রিয়াদ হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেল। এরপর সারাদিন আর পারুলের সময় কাটেনা। সকালের ঘটনাটা নিয়ে অনেক ভেবেছে। কিছুই বুঝতে পারছে না কেন রিয়াদ ওমন করল! দুপুরের দিকে আকাশ কালো হয়ে এল। বৃষ্টি হল খুব। বৃষ্টি দেখে পারুল আনমনা হয়ে গেল। ইস! এখন যদি উনি থাকতেন। একসাথে ভেজা যেত! বিকেলের দিকে রিয়াদ ফোনে জানালেন যে, আজকে তার ফিরতে দেরি হবে। অফিসে জরুরী মিটিং আছে। পারুলের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেল। মোমবাতি জ্বালিয়ে একা একা বসে থাকতে কার ভাল লাগে? পারুলেরও লাগছে। দু-একবার মোবাইলটা হাতে নিয়েও রেখে দিয়েছে। রিয়াদকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছিল। পরে বিরক্ত করা হবে ভেবে আর দেয়া হয়নি। পারুল হঠাৎ খেয়াল করল ঘরটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। মোমবাতির আলোটাও কেমন নিভু নিভু হয়ে আসছে। পারুলের গাঁ শিরশির করে উঠল। মনের ভিতর ভয়টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। “পারুউউউল্ল!” – কে যেন ফিসফিসিয়ে উঠল। “ক্বে..কে?” – পারুলের গলা কেঁপে গেল। “আমিইইহহ…” “আমি কে?” “তুমি আর আমিতো একই।” এবার পারুল কন্ঠস্বরের উৎসটা বুঝতে পারল। কথাগুলো আয়নার ভিতর থেকে আসছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে আয়নাটার দিকে এগিয়ে গেল। ঐতো পারুলকে দেখা যাচ্ছে। কে কথা বলে!!??? আয়নার ভিতরের ছায়াটা হঠাৎ নড়ে উঠল। পারুল চমকে গেল। সেতো নড়ে নি। ছায়াটা নড়ল কিভাবে?!! ছায়াটা আরো এগিয়ে আসতে লাগল। পারুল ভয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। পারুলের চোখের সামনে ছায়াটা আয়না থেকে বেড়িয়ে এল। পারুল পিছু হটতে হটতে দেয়ালের সাথে সেঁটে গেল। “কে তুমি?” “হি হি…ভয় পাচ্ছো কেন? তুমি আর আমিতো একই।” “না না…তুমি আয়না থেকে বেড়োলে কি করে?” “এটা একটা অভিশপ্ত আয়না। অনেককাল আগে এক রাজকন্যার খুব প্রিয় আয়না ছিল এটি। সেই রাজ্যের রাজা পাশের রাজ্যের রাজার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন। রাজকন্যার ঘরের এই আয়নাটি রাজার খুব পছন্দ হয়। আয়নাটা সরিয়ে নিতে চাইলে রাজকন্যা রাজার সৈন্যদের বাধা দেয়। তখন এক সৈন্য তাকে হত্যা করে। মারা যাবার আগে রাজকন্যা অভিশাপ দিয়ে যায়, এই আয়না যার কাছে থাকবে সে-ই ধ্বংস হয়ে যাবে। যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হবে তার! হা হা…! আজকেই তোমার শেষ দিন।
লিখেছেন:আহমাদ রবিন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন