শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

ফ্ল্যাট নং 06A

আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে । এই বৃষ্টি
মাথায় নিয়েই ক্লাস করে কাজ শেষে
সন্ধ্যায় আমার হোস্টেলে ফিরলাম। মাত্র
কয়েক দিন হল আমি এই পরবাসের জীবনে
দিন রাত পার করছি । লিফটের সামনে
দাঁড়িয়ে ওপেন বোটমে চাপ দিলাম।
অপেক্ষার প্রহর শেষ করে লিফটের দরজা
খুলে গেল, আমি লিফটের ভিতর ঢুকে সাত
তলার যাওয়ার জন্য সেভেন বোটমে চাপ
দিলাম । লিফট উপরে চলতে শুরু করে দিল ।
মনটা কেমন যেন করছে । অদ্ভুত এক খেয়াল
উকি দিচ্ছে মনে । আজগুবি চিন্তা করতে
করতে লিফট কখনযে সাত তলায় এসে থামল
আমি টেরই পেলামনা । লিফটের দরজা
খুলে গেল, আমি ধীর পায়ে আমার
ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়ালাম ।আমার
ফ্ল্যাটের নাম্বারটা কেমন যেন আজব ০6A,
থাকি ৭ তলায় আর ফ্ল্যাটের নাম্বার হল০6A
। গাঁটা ছম ছম করছে মনে হচ্ছে অশুভ কিছু
একটা হতে যাচ্ছে । আশুভ কিছু একটা যেন
অপেক্ষা করছে আমার জন্য । সব ভয় দূর করে
দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকলাম।আজ কেউ নেই
বলেই বিভিন্ন চিন্তার দানা বাঁধছে মনের
ভিতর । আমাদের ফ্ল্যাটে মোট আমরা আট
জন থাকি। আজ কেউ নেই রুমে। তিন জন
ছেলে দেশে গিয়েছে হলি ডেতে, আর
বাকি ছেলে গুলোর আজ রাতে কাজ ।
ফ্ল্যাটে ঢুকে রুমগুলর বাতি জ্বালিয়ে
ফ্রেশ হয়ে লিভিং রুমে গিয়ে টিভি
দেখতে বসে গেলাম । এছাড়া আপাতত
আমার কোন কাজ নেই । ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি
হচ্ছে এখনো বাইরে, অন্ধকারে ছেয়ে
গেছে পুরো আকাশ । আমি টিভি দেখছি
সোফায় গাঁ হেলিয়ে দিয়ে । আমাদের
হোস্টেলে স্কাই টিভি নাই তাই একটা
ডিভিডি চালু করে দিলাম। হিন্দি ছবি
আমার ভাল লাগেনা তার পরও দেখতে
থাকলাম এক মনে । হঠাৎ টয়লেটের কল
থেকে পানি পড়ার শব্দ কানে আসল ।
ভ্রুকটি করে অলসতা ভেঙ্গে টয়লেটের
দিকে গেলাম । মনে হয় ভুলে গিয়েছিলাম
কল বন্ধ করতে, যখন মুখ হাত ধুয়েছিলাম। কল
বন্ধ করে আবার সোফায় গিয়ে বসলাম ।
আবার টিভি দেখায় মন দিলাম কিন্তু
আবারো টয়লেট থেকে পানি পরার শব্দ শুরু
হল ।
“কি ব্যপার আমি না এই মাত্র কল বন্ধ করে
দিয়ে আসলাম ।‘’ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন
করলাম টয়লেটের দিকে তাকিয়ে। আবারো
সোফা থেকে উঠে গেলাম টয়লেটে কল
বন্ধ করার জন্য ।টয়লেটে গিয়ে দেখলাম
আবারো পানির কল থেকে পানি পড়ছে ।
আবারো ভাল করে বন্ধ করলাম । সোফার
কাছে আসতে না আসতেই আবারো
টয়লেটের সবগুলো কল থেকে পানি পরার
শব্দ পেলাম। এইবার শিড়দার বেয়ে ভয়ের
শীতল শিহরণ বয়ে গেল আমার সারা শরীরে
। সবগুলো পশম দাঁড়িয়ে গেল, বিনা
কারনেই ঠান্ডা লাগতে লাগলো আমার।
নিজের অজান্তেই পা বারালাম টয়লেটের
দিকে,প্রতিটা কদম যেন এক মণের মত
ভারী হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে টয়লেটের
ভিতর উকি দিয়ে দেখলাম,সবগুলো কল
থেকে একসাথে পানি পড়ছে। কাঁপা কাঁপা
পায়ে টয়লেটের ভিতর ঢুকলাম,বাতি
জ্বালিয়ে কলগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে
চেয়ে রইলাম কিছুখন তার পর ভীত সন্তুষ্ট
হয়ে কলগুলো বন্ধ করে দিলাম।খুব টাইট করে
কল গুলো বন্ধ করে আবারো ফাইনাল চেক
করে টয়লেট থেকে বের হলাম। ধীর পায়ে
আবারো লিভিং রুমে গিয়ে সোফায় বসে
হিন্দি ছবির দিকে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা
করতে লাগলাম আর মন থেকে সব ভয় দূরে
সরানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। হঠাৎ
টিভির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল আর কান্নার সুর
ভেসে আসতে লাগল, কান্নার সুর শুনে মনে
হচ্ছে কোন মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না
করছে । ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা
কোথাথেকে কান্নার শব্দটা আসছে। আমি
এইবার সোজা হয়ে বসলাম,কান দুট খাড়া
করে বুঝার চেষ্টা করতে লাগলাম কোন ঘর
থেকে শব্দটা আসছে। আমি সোফা থেকে
উঠে দাঁড়ালাম আর ভয়ে ভয়ে এদিক
সেদিক দেখতে লাগলাম। আমার কাছে
মনে হতে লাগল টয়লেট থেকে কান্নার
শব্দটা ভেসে আসছে, আমি টয়লেটের
কাছে আসলাম আর খুব ভাল করে শোনার
চেষ্টা করলাম আসলে ব্যপারটা কি। আমার
কি হেলুশসেনেশন হচ্ছে? টয়লেটের দরজার
কাছে আসতেই মণে হল কে যেন ভিতর
থেকে হাতের নখ দিয়ে দরজার গাঁয়ে আচর
কাটছে আর কান্নার শব্দও অনেক জড়ে
জড়ে হতে লাগলো ।আমার ভয়ে জ্ঞান
হারানোর মত অবস্থা ।আমি অনেক সাহস
সঞ্চার করে দরজার বাইরে থেকে
জিজ্ঞাস করলাম ‘‘কে? ভিতরে
ক..ক..কে?’’আমার প্রশ্নের কোন জবাব
পেলাম না কিন্তু কান্না ও আওয়াজ থেমে
গেল । আমি সাহস করে টয়লেটের দরজা
খুলে ভিতরে উঁকি দিলাম । কেউ নেই মনটা
একটু শান্ত হল। সব ঠিক দেখে ব্যপারটাকে
আমার হেলুসেনেশন ছাড়া আর কিছু রায়
দিতে পারলাম না। টয়লেটের প্রতিটা
কোনায় কোনায় চেক করলাম কিছুই নেই।
সব কিছুই ঠিক আছে , মিছে মিছে ভয়
পাচ্ছি ।কাল রাতে ঘুমাইনিতো তাই এমনটা
লাগছে। মন থেকে ভয়ে ঝেড়ে ফেলে
টয়লেট থেকে বের হয়ার সময় ঘটল অঘটন ,
আমি যেই না টয়লেট থেকে বের হব ঠিক
তখনি আমার বাম হাতটা কে যেন পিছন
দিক থেকে চেপে ধরল। হিম শীতল একটা
অনুভূতি বয়ে গেল আমার সারা শরীরে ।
মৃতদের শরীর কি এত ঠাণ্ডা হয়ে থাকে?
স্বজড়ে ‘‘কে’’ বলে চিৎকার দিয়ে পিছন
দিকে ফিরে তাকালাম । কেউ নেই!
আশ্চর্য কেউ নেই? অথচ আমার মনে হল
আমার হাত কে যেন চেপে ধরেছে ।আমি
স্পষ্ট অনুভব করেছি যে কেউ আমার হাত
চেপে ধরেছে বরফ শীতল একটা শক্ত হাত
দিয়ে । কেউ নাই পুরো টয়লেট খালি। আমি
ভয়ে ভয়ে টয়লেটের দরজা লাগিয়ে দিয়ে
লিভিং রুমের দিকে পা বাড়ালাম আর
বার বার পিছনে ফিরে টয়লেটের দরজার
দিকে তাকাতে থাকলাম । লিভিং রুমে
এসে দেখি টিভি ঠিকঠাক চলছে কোন
ডিষ্টাব নেই । আমি আবারো সোফায় বসে
টিভি দেখায় মন দিলাম । বাম হাতটা কেন
জানি একটু ব্যাথ্যা করছে, আমি আমার
ডান হাতটি দিয়ে বাম হাতে ঘষতে
লাগলাম । হঠাৎ টিভি বন্ধ হয়ে গেল,অথচ
ঘরে বিদ্যুৎ আছে। আমি লিভিং রুমের
লাইটগুলো জ্বালিয়ে রেখেছিলাম ওগুলো
জ্বলে আছে । আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই
টিভি আবার চালু হল । প্রথমে ব্লাঙ্ক তার
পর ঝিরঝির হতে লাগল। কিছুই বুঝতে
পারছিনা কি হচ্ছে এই সব আমার সাথে।
আমি কি পাগল হয়ে যাব? রিমোট নিয়ে
চ্যানেল পালটাতে থাকলাম কিন্তু কোন
কাজ হল না। ঝিরঝির শব্দ আর ঝিরঝির শব্দ
। ‘‘আরে ওটা কি?’’ টিভিতে কিছু একটা
যেন দেখতে পেলাম আমি,একটা মেয়ের
ছবি অস্পষ্ট ঝিরঝির। আরে টিভি থেকে
সেই কান্নার শব্দ ভেসে আসছে তার সাথে
একটা গোংগানির শব্দ । টয়লেটের সেই
শব্দটা আবারো কানে আসতে শুরু করলো ।
কেউ যেন নখ দিয়ে টয়লেটের দরজায় আচর
কাটছে , মনে হচ্ছে হিংস্র কোন পশু
টয়লেটে আটকা পরেছে । আমার টনক
নড়লো হচ্ছেটা কি এসব ? আমি টিভির
রিমট দিয়ে টিভির চ্যানেল বদলাতে
থাকলাম কিন্তু কোন কাজ হল না। ঝিরঝির
কিছুটা কমতে লাগল আর গোংগানির শব্দ
বারতে থাকল। তার সাথে টয়লেটের আচর
কাটার শব্দও। টিভির ঝিরঝির একে বারে
চলেগেল সেখানে আসতে আসতে একটা
মেয়ের মুখ ভেসে উঠল । আমি বুঝে উঠতে
পারছিনা আমি কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছি
না আসলেই যা হচ্ছে তা বাস্তব ! টিভির
মধ্যে মেয়ের মুখটা আসতে আসতে কেমন
যেন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে আর টয়লেটের আচর
কাটার শব্দও কমে যাচ্ছে। ভয়ে আমার হাত
পা অবশ হয়ে যাচ্ছে । আমি নড়াচড়ার
শক্তি হারিয়ে ফেলেছি । টিভির ভিতরের
মেয়েটার চেহারা পুরো বিকৃত হয়ে গেল
আর ঐ বিকৃত চেহারার মধ্যে এক জোড়া
লাল টকটকে চোখ চেয়ে আছে আমার
দিকে । হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পরল
মেয়েটা আর টিভি থেকে হঠাৎ গায়েব
হয়ে গেল । আর টিভিতে সেই ঝিরঝির
দেখা দিল আবার । আমি হিমশীতল হয়ে
বসে আছি , আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে
গেছে, শরীর যেন সোফার সাথে মিশে
যেতে চাচ্ছে। ঠিক তখনি আমার মনে হল
কে যেন আমার পিছনে দাঁড়িয়ে
আছে,আমার ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাসের
ছোঁয়া অনুভব করছি আমি। নিঃশ্বাসের
ফোঁস ফোঁস শব্দের সাথে পশুর গোংগানির
মত কেমন যেন একটা শব্দ আসছে আমার
পিছন দিক থেকে । আমি ভয়ে আমসত্তা
হয়ে গেলাম । পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে যা
দেখলাম তা জীবনেও কোন দিন ভুলবনা ।
টিভির ভিতরে যে মেয়েটা ছিল সেই
মেয়েটাই আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ।
আমার দিকে ওর সরু হাত দুটি বাড়িয়ে
দিচ্ছে। আমি আর আমার নার্ভ সিস্টেম কে
ঠিক রাখতে পারলাম না , আমি জ্ঞান
হারানোর আগপর্যন্ত যা দেখলাম তা হল ,
‘মেয়েটা আমার পা ধরে টয়লেটের দিকে
টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর আমি প্রান পনে
নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি । হাতের
নখ গুলো দিয়ে ফ্লরে খামচে ধরার চেষ্টা
করে যাচ্ছিলাম’ এর পর আর কিছু মনে নেই
আমার।

****

চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করলাম
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি। আর পাশে
বসে আছে আমার রুমম্যাট রঞ্জন । আমায়
চোখ খুলে তাকাতে দেখে ও বলল
‘‘Don’t move’ মাথায় শিলি লেগেছে
তিনটা । তুমি বাথ রুমে পরে গিয়েছিলে
কি করে?’’
‘‘আমি বাথ রুমে পরেগিয়েছিলাম?’’ মৃদ
কন্ঠে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম ।
‘ হু তোমার মনে নেই কিছু?, আমি রাতে
বাসায় ফিরে দেখি তোমার শরীর আধা
বাথ রুমের ভিতরে আর আধা বাইরে পরে
আছে ।আর মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে । আমি
আর দেড়ি না করে তোমাকে হসপিটালে
নিয়ে আসলাম ।’’
রঞ্জন একটু থেমে আবার আমায় বলল
‘‘আচ্ছা ডাক্তার আমায় একটা কথা
জিজ্ঞাস করেছিল ।’’
আমি মৃদু কণ্ঠে বললাম ‘কি?’
‘‘তোমার বাম হাতে আর বাম পায়ে কার
যেন হাতের ছাপ, মনে হচ্ছিল তোমাকে
কেউ খুব জোরে চেপে ধরে রেখেছিল।’’
তার মানে আমি যা দেখেছিলাম তা সব
সত্যি ।মনে মনে কথা গুলো বললাম ।
আমি সাথে সাথে আমার বাম হাতের
দিকে চাইলাম , হাতের মধে স্পষ্ট দেখা
যাচ্ছে পাঁচটা আঙ্গুলের ছাপ , আমি কোন
মতে বসে আমার পায়ের দিকে তাকালাম ,
ওখানেও একই অবস্থা ।
বছর খানেক পর , আমার শরীরে আজও সেই
আঙ্গুলের ছাপ আছে । আজ ও আমি সেই
দিনের কথা মনে করে নিজে নিজেই
শিউরে উঠি। সেই ঘটনার পর আমি আর সেই
হোষ্টেলে থাকতে পানিরি । আমি
হোষ্টেল চেঞ্জ করে ডাবলিনের এক
বাঙ্গালীর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট
হিসাবে উঠেছি । পরে খোঁজ নিয়ে
জানতে পেরেছি যে ঐ ফ্ল্যাট নং 06A
তে এর আগেও অনেক ঘটনা ঘটেছে , আমিই
প্রথম না।ঐটা একটা হন্টিং ফ্ল্যাট। আমি
আসার পর ও একে একে সবাই কিছু না কিছু
অঘটনের শিকার হয়েছে । হয়ত কোন দিনো
এর কূলকিনারা করতে পারব না কিন্তু কিছু
একটা রহস্য আছে যা অজানাই রয়ে গেল।

প্রকাশক:Pishach (পিশাচ) A Ghost Story


আয়না

ঢাকা শহরে অল্পদিনের নোটিসে বাসা খুজে
পাওয়া খুব কঠিন। তারপরও কিভাবে কিভাবে যেন
ম্যানেজ হয়ে গেল। অবশ্য বাসা একটু ছোট আর মূল
সড়ক থেকে ভিতরের দিকে। গলিটাও ভাঙাচোড়া,
গর্তে ভর্তি। এদিকটায় এখনো দু’একটা বদ্ধ ডোবা
চোখে পড়ে। আশে পাশে উচু দালান-কোঠা কম।
আমাদের ফ্ল্যাটটা পাঁচতলায় হওয়ায় আশে-পাশের
কোলাহল, ধূলাবালি একটু কমই লাগে। বেশ
নিরিবিলি। আমার এমনই পছন্দ। একাকী-নিরিবিলি
থাকতেই আমার ভাল লাগে।
ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়ার নেশা। এখন
আরো ভাল করে বই পড়া যাবে। আমাদের বিয়ে
হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। বাবা-মাকে ছেড়ে
ঢাকায় আসতে প্রথমে খুব খারাপ লাগলেও এখন
লাগছে না। এমন ছোট্ট, নিরিবিলি, ছিমছাম
সংসারই আমি মনে মনে চাইতাম। উনি অফিসে চলে
গেলে আমিতো একাই! নিজের মত করে ঘর-দোর
সাজানো যাবে।
এই বাড়িটা বেশ পুরোনো মনে হচ্ছে। স্থান স্থান
ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছিল। সেগুলো
পরিষ্কার করতে কষ্ট হয়েছে খুব। এখনও মাঝে
মাঝে পড়ে। বিছানা-মেঝে ময়লা হয়ে যায়। উনি
বলেছেন, আপাতত এই বাসায় থাকব আমরা। আরেকটু
ভাল বাসা পেলেই সেখানে যেয়ে উঠব।
বাসার মধ্যে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল
বেডরুমের দেয়ালে লাগানো প্রমাণ সাইজ আয়না।
লম্বায় মনে হয় পাঁচ ফিটের কম হবে না। পাশেও
প্রায় দুই ফিট। আয়নার কাঁচের চারপাশে আবার
কারুকার্যখচিত কাঠের ফ্রেম লাগানো। অনেকটা
রাজা-বাদশাদের ঘরে যেমন দেখা যায় সিনেমায়।
উপরের অংশে কাঠের মধ্যে ডায়মন্ড আকৃতির
একটা ফাঁক। দেখে মনে হয় কিছু একটা ছিল ওর
মধ্যে। এত বড় আয়না দিয়ে কি হত, কেনইবা এই
আয়না তৈরি করা হয়েছিল- কে জানে!
দিনকাল ভালই চলছিল। মাঝখানে গোলমাল করে
দিল দেয়াল আলমারিটা। জিনিসপত্র আলমারীতে
রাখতে হবে। ধূলাবালি ঝাড়তে যেয়ে কিসের যেন
টুং করে আওয়াজ হল। তাকিয়ে দেখি লাল একটা
পাথর। এত্ত সুন্দর! আমি হাতে নিলাম। হাতে নিতেই
পাথরটা যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠল। আমি সম্মোহিত
হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানি মনে হল পাথরটা
আমাকে কিছু বলতে চায়!
একটু পরেই মাথায় আসল পাথরটাতো অবিকল
আয়নার ঐ ফাঁকের মত। তাহলে কি ওটা ওখানেই
ছিল? ওখানে থাকলে খুলে রাখল কে? কেন রাখল?
সাতপাচঁ ভাবতে ভাবতে আমি আয়নাটার সামনে
দাড়ালাম। ঐতো আমাকে দেখা যাচ্ছে। পাথর
হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এগিয়ে গিয়ে ড্রয়িং
রুম থেকে ছোট একটা চেয়ার নিয়ে আসলাম।
তারপর ঐ চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে পাথরটা কাঠের
ফ্রেমের ঐ গর্তে ঢুকিয়ে দিলাম। সাথে সাথে মনে
হল আয়না হালকা একটু ঝাকি খেল। আমি অবাক
হয়ে গেলাম। আঙুলে দিয়ে পাথরটা বের করতে
চাইলাম। কি আশ্চর্য্য! পাথরটা বের হচ্ছে না।
মনেহচ্ছে পাথরটার চারপাশের কাঠের দেয়াল
পাথরটাকে চেপে ধরে রেখেছে।
একটু টানা হেচড়া করতেই পাথরটার খসখসে একটা
কোন আঙুলের মাথায় লেগে আঙুল কেটে গেল।
“উহ!!!”
মুখ দিয়ে অস্ফুষ্টে বেড়িয়ে এল। আঙুলের মাথায়
রক্তবিন্দু দেখতে পেলাম। পাথরটাতেও লেগেছে।
পাথরটা লাগা রক্তবিন্দুটা আমার চোখের সামনে
পাথরের মধ্যে হারিয়ে গেল। পাথরটা যেন রক্ত
শুষে নিল। আমার অবাক হবার ক্ষমতাও হারিয়ে
গেছে। আমি চেয়ার থেকে নেমে ধপ করে
বিছানায় বসে পড়লাম।
এই ছোট্ট ঘরে এই প্রথম আমার একটু ভয় ভয় করতে
লাগল। আয়নাটার দিকে তাকিয়ে মনে হল আয়নাটা
আগের চেয়ে উজ্জ্বল লাগছে। মনেহচ্ছে আয়নার
ভেতরের কেউ একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি রান্না ঘরে চলে আসলাম। বেডরুম, ডাইনিং,
কিচেন আর একটা বাথরুম নিয়ে আমার রাজত্ব।
বেডরুমের পাশের বারান্দাটা খুব সুন্দর। রাতের
বেলা ঠান্ডা হাওয়া আসে। শীত শীত লাগে।
এঘর ওঘর ঘুরতে ঘুরতে আমার প্রচন্ড নিঃসঙ্গ
লাগতে শুরু করল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে উনাকে
মেসেজ পাঠালাম একটা।
“আপনি আজকে একটু জলদি আসতে পারবেন?”
উনি খুব ছোট্ট করে রিপ্লে দিলেন, “আচ্ছা।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটায়
তিনি চলে এলেন। দরজা খুলে উনার চিন্তিত মুখ
দেখে মনে অন্যরকম এক ভাললাগার তৈরি হল।
“কি ব্যাপার? কি হয়েছে?”
“আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। তারপর বলছি।”
উনি ফ্রেশ হতে হতে আমি চট করে দু’কাপ চা করে
ফেললাম। চায়ের কাপ উনার হাতে দিয়ে সবকিছু
খুলে বললাম। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা
শুনলেন। বিশ্বাস করলেন কিনা বোঝা গেল না।
“চলতো দেখি।”
বেডরুমে যেয়ে উনি খুব খুটিয়ে খুটিয়ে আয়নাটা
দেখতে লাগলেন। ধাক্কা দিয়ে সরাতেও চাইলেন।
আয়না সরানো গেল না। পুরনো বাড়িতে অনেক
গোপন ব্যাপার-স্যাপার থাকেস; এমনটা বইয়ে,
টিভিতে অনেক সময় পাওয়া যায়। গোপন কুঠুরী,
গোপন সুইচ-তন্ন তন্ন করে খুজেও তেমন কিছু পাওয়া
গেল না।
“হয়ত তোমার মনের ভুল। সারাদিন বাসায় একা একা
থাকো। এমন হতেই পারে। তারপরও যদি তোমার এমন
কিছু আবারও মনে হয় তবে বলো। আয়নাটা সরানোর
ব্যবস্থা করতে হবে।”
এরপর সারাদিন আমার আমার অনেক আনন্দে কাটল।
বিকেল বেলা ঘুরতে বের হলাম। উনি অনেক গল্প
করলেন আমার সাথে। আমিও টুকটাক কথা বলতে
লাগলাম। ধীরে ধীরে মানুষটার সঙ্গ আমার কাছে
উপভোগ্য হয়ে উঠছে। আমি নিজেকে মেলে ধরতে
শুরু করেছি। জীবনটা বড় সুন্দর লাগছে।
রাতের খাবার আমরা বাইরেই খেলাম। বিকেলে এত
ঘুরাঘুরির পর শরীর অনেক ক্লান্ত হলেও ঘুম আসতে
চাইল না। আজকে ঠান্ডা একটু বেশি লাগছে। উঠে
গিয়ে বারান্দায় যাবার দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
আবার এসে শুয়ে পড়লাম। অস্থির অস্থির লাগছে।
কেন? এমন লাগবে কেন? চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে
চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ করে কিসের যেন খসখস শব্দে আমার কান
খাড়া হয়ে গেল। চোখ না খুলেই কান পাতলাম।
কিছু শোনা যায় কিনা! কিছু শোনা যাচ্ছে না।
দেহে ঢিল দিয়ে যখন মনেহল চোখের পাতা ভারী
হয়ে আসছে তখন আবার কি যেন শুনলাম। আবারো
কানপেতে রইলাম। এবার আর অপেক্ষা করতে হল
না। আবারো শুনলাম।
“পাআআআরুউউউউউল্ল্ল!”
কে যেন মোলায়েম গলায় আমার নাম ধরে ডাকছে।
কন্ঠটাও পরিচিত পরিচিত লাগছে। আয়নাটার
দিকে তাকালাম। আবারো কেউ ডাকল,
“পাআআরুউউউউউল্ল্ল”
এবার আমার মনে হল ডাকটা আয়নার ভেতর থেকে
আসছে। ভয়ে আমার হাত-পা পেটের ভিতর
সেধিয়ে যেতে লাগল। আমি উনাকে পিঠের উপর
দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। উনি সজাগ হয়ে গেলেন।
পাশ ফিরে বললেন,
“কি হয়েছে?”
“কিছু না, কিছু না।”
উনি বোধহয় বুঝতে পারলেন আমি ভয় পেয়ছি। হাত
বাড়িয়ে আমাকে আরো কাছে টেনে নিলেন।
উনার বুকের মধ্যে মাথা রেখে একসময় আমি ঘুমিয়ে
পড়লাম।
*******************

সকালবেলা রাতের কথা মনে হতে আমার হাসি
পেতে লাগল। আপনমনে ঘরের কাজ করতে লাগলাম।
একটু একটু করে গোছাই। পছন্দ হয় না। আবার নতুন
করে গোছাই। দশটার দিকে দরজায় কড়া নাড়ার
শব্দে চমকে উঠলাম। এই সময় আবার কে এল!!
দরজা খুলে একটা হাসিখুশি মুখ চোখে পড়ল। ২৮-৩০
বছরের এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে অবাক
হয়ে তাকাতে দেখে মৃদু হাসি দিয়ে বললেন,
“আপনি নিশ্চয়ই এ বাসার ভাবি? আমি আপনাদের
উপরের ফ্ল্যাটে থাকি। আপনাদের সাথে পরিচিত
হতে এসেছি। কি, ভিতরে আসতে বলবেন না?”
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আসুন, আসুন।
খুব খুশি হলাম আপনি এসেছেন। আসলে আমারই
যাওয়ার দরকার ছিল। বাসা এখনো গুছিয়ে উঠতে
পারি নি। তাই যাওয়া হয় নি। কোথায় যে
আপনাকে একটু বসতে দেই!!”
“না, না। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমিও তাই
ভেবেছিলাম যে হয়ত এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেন
নি। প্রথম প্রথম অনেক ঝামেলা হয়। কোন হেল্প
লাগে কিনা সেটাও দেখতে এলাম।”
“খুব ভাল লাগল ভাবি।”-উনার আন্তরিকতায়
আসলেই আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কথা বলতে বলতে
উনাকে নিয়ে আমি শোবার ঘরে চলে আসলাম।
“ভাবি চা করে আনি?”
“চা করবেন? ঠিক আছে। আমি কিন্তু রঙ চা খাই।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি এখানেই বসুন। আমি
আসছি।”
চা নিয়ে এসে দেখি উনি আয়নাটার সামনে
দাঁড়িয়ে আছেন।
“আপনাদের আয়নাটা খুব সুন্দর।”- চা নিতে নিতে
উনি বললেন।
“হুম!”
“আপনার বুঝি চায়ের খুব তৃষ্ণা? আমারো। আমি
রাত-বিরেতেও চা খাই। আপনাকেও কাল রাতে
বারান্দায় চা খেতে দেখলাম…”
“আমাকে?” আমিতো অবাক। “কালরাতে? কখন?”
“এইতো বারোটার দিকে…”
“ভাবি মনেহয় ভুল দেখেছেন।
“কি যে বলেন, ভুল দেখব কেন? নাকি আপনাদের
এখানে আরো কেউ আছে?”
“জ্বী না ভাবি। আমি আর আপনার ভাই ছাড়া আর
কেউ নেই। আর কালকে আমরা সারাদিন ঘোরাঘুরি
করেছি। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। এসেই ঘুমিয়ে
পড়েছি।”
“তাই?!!” শীলা ভাবির গলায় অবিশ্বাস! ওহ, বলতে
ভুলেই গিয়েছি। ভাবি তার নাম বলেছেন শীলা।
“তাহলে হয়ত আমারই ভুল হয়েছে।” বলার ভঙ্গিতে
বোঝা গেল মুখে বললেও তিনি মনে মনে মেনে
নিতে পারছেন না। তবে এ ব্যাপারে আর কিছু
বললেন না।
“ঠিক আছে ভাবি। আজকে তাহলে উঠি। আরেকদিন
আসব। আপনিও আমাদের বাসায় আসবেন সময় করে।
আমি একা এসেছি। আপনি ভাইকে নিয় আসবেন।”
“আচ্ছা।” আমি হেসে ফেললাম। “আপনিও আবার
আসবেন। সারাদিনতো একাই থাকি। আপনি আসলে
ভাল লাগবে।”
শীলা ভাবি চলে গেলেন। আমি ঘরের কাজকর্ম
সামলাতে লাগলাম।
উনি আজকেও একটু আগে ফিরলেন। সঙ্গে মধ্যবয়স্ক
এক মহিলা।
“আগে থেকেই খুজছিলাম। আজকে পেয়ে গেলাম।
উনি আজ থেকে আমাদের সাথেই থাকবেন। ঘরের
কাজকর্মে তোমাকে সাহায্য করবেন।”
ভালই হল। সারাদিন একা একা থাকতে আর কত ভাল
লাগে! আমি খালাকে ঘরের কাজকর্ম বুঝিয়ে
দিতে লাগলাম। খালা কাজকর্মে বেশ পটু মনে হল।
কথাও কম বলেন। রাতে বেলা ডাইনিং রুমে
বিছানা করে শুয়ে পারবে বলে জানিয়ে দিলাম।
সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘরে একটা
মোমবাতিই ছিল। খালাকে বললাম জালিয়ে
শোবার ঘরে দিয়ে যেতে। এর মধ্যে উনি আবার
বের হলেন। আরো কয়েকটা মোমাবাতি নিয়ে
আসবেন। বিদ্যুতের কথা বলা যায় না। কখন ফিরে
কে জানে।
মোমবাতি নিয়ে খালা যখন শোবার ঘরে ঢুকলেন
তখন আমি বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।
আমার দিকে চোখে পড়তেই খালা চমকে উঠলেন।
হালকা চিৎকার দিলেন। মোমবাতিটা তার হাত
থেকে পড়ে গেল। একছুটে বেড়িয়ে গেলেন। তার
চিৎকার শুনে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু আসে
পাশে তাকিয়ে কিছুই দেখলাম না। খালার পিছু
পিছু আমিও বের হয়ে এলাম।
খালার আচরনে আমি খুব অবাক হলাম। খালা
রান্নাঘরে ঢুকে ভিতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে
দিয়েছেন। আমার বিস্ময় আকাশে পৌছল যখন
ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ পেলাম। বেশ
কয়েকবার ডাকার পরও সে যখন সাড়া দিল না তখন
শোবার ঘরে এসে গুম হয়ে বসে রইলাম।
একটু পরে আম সচকিত হয়ে উঠলাম। মনেহল কে যেন
আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখছে। আর
ঘরটাও একদম শীতল হয়ে গিয়েছে। গ্রীষ্মকাল,
বৃষ্টির নাম-গন্ধও নেই। অথচ ঘরের ভিতর শীতকালের
আবহাওয়া।। আয়নাটার দিকে তাকালাম। অদ্ভূত
একটা আভা বের হচ্ছে আয়নাটা থেকে। শীতে,
ভয়ে শরীর কেঁপে উঠল। আমি বিছানা থেকে নেমে
ডাইনিং রুমে আসতেই কলিং বেলের শব্দ পাওয়া
গেল।
উনি বোধহয় এসেছেন দরজা খুলে দিতেই বিদ্যুৎ
চলে আসল। আমি ফ্যাকাসেভাবে হাসার চেষ্টা
করলাম। আমার নিষ্প্রাণ হাসি উনার চোখ এড়াল
না।
“কি হয়েছে?”
আমি সবকিছু খুলে বললাম। উনি যেয়ে রান্নাঘরের
দরজায় নক করে খালাকে ডাক দিলেন। কিছুক্ষন
ডাকাডাকি করার পর খালা দরজা খুলেই বললেন,
“আমি আর এই বাসায় কাম করুম না।”
“কেন? কি হয়েছে?”
“কিছু হয় নাই। আমি কাম করতে পারুম না।”
খালার গলা শুনেই বোঝা গেল এই ব্যাপারে তার
সাথে কথা বলে আর লাভ হবে না। উনি খালাকে
অন্তত আজরাতটা থেকে যেতে রাজি করালেন।
আসলেই এই রাতের বেলা কোথায় যাবেন!
রাতে ভাল ঘুম হল না। ছেড়ে ছেড়ে দুঃস্বপ্ন
দেখতে লাগলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমি ঘুমিয়ে
আছি। আমিই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলছি।
মাঝখানে শীতে একবার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবার এসে শুয়ে
পড়লাম।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল।
উঠে দেখি উনি অফিসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছেন।
আমাকে উঠতে দেখে বললেন,
“ঘুম ভাঙল? খালা চলে গেছেন। তোমাকে ঘুমাতে
দেখে আমি আর ডাকলাম না। আজকে নাহয় বাইরেই
নাস্তা করে নেব।”
একটু হেসে উনি বেরিয়ে গেলেন।
*********************
বাসা থেকে হেসে বিদায় নিলেও রিয়াদ মনে মনে
খুব চিন্তিত। কি যে হচ্ছে এসব! বিয়ে করেছে এই
সেদিন। বউটাও খুব ভাল। কিন্তু এ কি ধরনের
ঝামেলা! কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নিচে নামতেই
গেটের দাড়োয়ানের সাথে দেখা।
“স্যার, ম্যাডামের কি হয়েছে?”
“কি হয়েছে মানে? কি হবে?”
“না, সকাল বেলা আপনাদের বাসার কাজের বুয়া
চলে যাবার সময় আমার সাথে একটু কথা হয়েছে।
কি বলল, মাথামুন্ডু কিছু বুঝলাম না।”
“কি বলেছে?”
“না স্যার, আপনি রাগ করবেন।”
“না, রাগ করব না। বলে ফেলো।”
“না মানে স্যার, বুয়া বলল, ম্যাডাম নাকি মানুষ
না, জ্বীন! ম্যাডামের নাকি ছায়া নাই।”
“কি নেই!!!”
“ছায়া নেই স্যার, ছায়া! এই দেখেন স্যার আপনার
কত বড় ছায়া। আপনারটার পাশে আমার ছায়া।
ম্যাডামের নাকি ছায়া নাই!!!???”
দাড়োয়ানের কথা শুনে রিয়াদ স্তম্ভিত হয়ে গেল।
কি আশ্চর্য্য! ছায়া থাকবে না কেন? এটা কোন
কথা!
দুঃশ্চিন্তা নিয়ে রিয়াদ গেট থেকে বেরোতে
যেয়েও থেমে গেল। আবার সিড়ি ভেঙ্গে উপরে
উঠতে শুরু করল।
রিয়াদকে আবার ফিরে আসতে দেখে পারুল খুব
অবাক হল।
“আমার কিছু কাগজপত্র ফেলে গিয়েছি।”- রিয়াদ
অপ্রস্তুত।
পারুল হেসে ফেলল। দরজা ছেড়ে দিয়ে ভিতরে
ঢুকে গেল। রিয়াদ বেডরুমে ঢুকে শুধুই এটা-ওটা
উলটে পালটে দেখতে লাগল।
“পারুল এদিকে এসো তো।”
ডাক শুনে পারুল বেডরুমে আসল। হাতে টুথপেস্ট আর
ব্রাশ।

“আমি কি দোষ করেছি? আমাকে মারবে কেন?” “দোষ! না তুমি কোন দোষ করনি। তুমি আমাকে জীবিত করেছো। ঐ পাথরটাই আমার প্রাণ। আয়নাতে তুমি পাথরটাতে লাগানোর সাথে সাথে আমি জীবন্ত হই। আর তোমার ছায়া আয়নাতে আটকে যায়। আর সেই ছায়াতে ভর করে অভিশাপ। এখন সেই অভিশাপের বলি হবে তুমি। আর তোমার জায়গায় সংসার করব আমি!” “আমাকে মেরো না।” পারুলের গলায় কান্নার সুর। “আমি চলে যাব। তুমি সংসার করো। আমি আর কোনদিন ফিরে আসব না।” “তোমাকে হত্যার না করা পর্যন্ত আমি পূর্ণতা পাব না। এবার প্রস্তুত হও।” বলেই ছায়াটা শাড়ির আঁচল গলায় পেচাতে লাগল। তীব্র ভয় নিয়ে পারুল দেখল তার শাড়ির আঁচলটাও তার গলায় পেচিয়ে গেল। পারুল আঁচল খামচে ধরে গলা থেকে সরিয়ে দিতে চাইল। কোন লাভ হল না। বরং একটু পরেই আঁচলটা গলায় চেপে বসতে শুরু করল। অক্সিজেনের জন্য পারুলে ফুসফুস হাঁসফাস করে উঠল। পারুল বুঝতে পারল মৃত্যু আর বেশি দূরে নেই। এরই মধ্যে অক্সিজেনের অভাবে চোখের সামনে লাল-নীল বাতি জ্বলে উঠতে শুরু করছে। দুর্বল হয়ে পারুল মেঝেতে পড়ে গেল। তাই দেখে ছায়ামূর্তি আরো জোড়ে হেসে উঠল। পারুল মেঝেতে পড়তেই শক্ত, গোলগাল কি যেন হাতে লাগল। পেপার ওয়েট! হাতের মুঠোতে নিয়েই পারুল শরীরের বাকিশক্তিটুকু দিয়ে পেপার ওয়েট টা আয়নার দিকে ছুড়ে মারল। ঝনঝন শব্দের সাথে সাথেই পারুল জ্ঞান হারাল। ************ পাঁচ বছর পর! পারুলরা এখন ভালই আছে। এই পাঁচবছরে পারুলে দু’টো সন্তান হয়েছে। দুটোই ছেলে। বড়টার বয়স তিন আর ছোটটার বয়স এক। দু’জনের দুষ্টুমি সামলাতে সামলাতেই পারুলের দিন চলে যায়। সেই পুরনো বাসা রিয়াদ ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। দুইপুত্র-স্ত্রী নিয়ে সে সুখেই আছে। তবে পারুলের মুখের দিকে তাকালে একটা খটকা তার সবসময়ই লাগে। অনেক ভেবে-চিন্তেও রিয়াদ কোন কূল-কিনারা করতে পারে না। পারুলের বাঁ গালের তিলটা কিভাবে ডান গালে এল? গত পাঁচটি বছর ধরে ভেবেও রিয়াদ কোন যোক্তিক উত্তর খুজে পায়নি। হতাশ হয়ে রিয়াদ ভাবে, জগতের কিছু রহস্য রহস্যই থেকে যায়। কখনই উদঘাটন হয় না! কিছু রহস্য থাক না গোপন!!

পারুল যেন বুঝতে না পারে এমনভাবে রিয়াদ পারুলের চারপাশে ঘুরতে লাগল। “কি খোজেন?” “ন্ না, কিছু না।” রিয়াদের গলায় ভয়। পারুল অবাক হয়ে গেল। “আমি যাই।” বলেই রিয়াদ হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেল। এরপর সারাদিন আর পারুলের সময় কাটেনা। সকালের ঘটনাটা নিয়ে অনেক ভেবেছে। কিছুই বুঝতে পারছে না কেন রিয়াদ ওমন করল! দুপুরের দিকে আকাশ কালো হয়ে এল। বৃষ্টি হল খুব। বৃষ্টি দেখে পারুল আনমনা হয়ে গেল। ইস! এখন যদি উনি থাকতেন। একসাথে ভেজা যেত! বিকেলের দিকে রিয়াদ ফোনে জানালেন যে, আজকে তার ফিরতে দেরি হবে। অফিসে জরুরী মিটিং আছে। পারুলের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে গেল। মোমবাতি জ্বালিয়ে একা একা বসে থাকতে কার ভাল লাগে? পারুলেরও লাগছে। দু-একবার মোবাইলটা হাতে নিয়েও রেখে দিয়েছে। রিয়াদকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছিল। পরে বিরক্ত করা হবে ভেবে আর দেয়া হয়নি। পারুল হঠাৎ খেয়াল করল ঘরটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। মোমবাতির আলোটাও কেমন নিভু নিভু হয়ে আসছে। পারুলের গাঁ শিরশির করে উঠল। মনের ভিতর ভয়টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। “পারুউউউল্ল!” – কে যেন ফিসফিসিয়ে উঠল। “ক্বে..কে?” – পারুলের গলা কেঁপে গেল। “আমিইইহহ…” “আমি কে?” “তুমি আর আমিতো একই।” এবার পারুল কন্ঠস্বরের উৎসটা বুঝতে পারল। কথাগুলো আয়নার ভিতর থেকে আসছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে আয়নাটার দিকে এগিয়ে গেল। ঐতো পারুলকে দেখা যাচ্ছে। কে কথা বলে!!??? আয়নার ভিতরের ছায়াটা হঠাৎ নড়ে উঠল। পারুল চমকে গেল। সেতো নড়ে নি। ছায়াটা নড়ল কিভাবে?!! ছায়াটা আরো এগিয়ে আসতে লাগল। পারুল ভয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। পারুলের চোখের সামনে ছায়াটা আয়না থেকে বেড়িয়ে এল। পারুল পিছু হটতে হটতে দেয়ালের সাথে সেঁটে গেল। “কে তুমি?” “হি হি…ভয় পাচ্ছো কেন? তুমি আর আমিতো একই।” “না না…তুমি আয়না থেকে বেড়োলে কি করে?” “এটা একটা অভিশপ্ত আয়না। অনেককাল আগে এক রাজকন্যার খুব প্রিয় আয়না ছিল এটি। সেই রাজ্যের রাজা পাশের রাজ্যের রাজার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন। রাজকন্যার ঘরের এই আয়নাটি রাজার খুব পছন্দ হয়। আয়নাটা সরিয়ে নিতে চাইলে রাজকন্যা রাজার সৈন্যদের বাধা দেয়। তখন এক সৈন্য তাকে হত্যা করে। মারা যাবার আগে রাজকন্যা অভিশাপ দিয়ে যায়, এই আয়না যার কাছে থাকবে সে-ই ধ্বংস হয়ে যাবে। যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হবে তার! হা হা…! আজকেই তোমার শেষ দিন।

লিখেছেন:আহমাদ রবিন



শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

বন্ধু

মাঝ রাতে দরজায় কড়া নাড়ারশব্দে ঘুম
ভেঙ্গে গেলো। আমিবিরক্ত ভাব নিয়ে
দরজা খুললাম।দরজা খুলেই বিস্মিত কণ্ঠে
বললাম- আরে তুই? এতো রাতে?
আকাশ একগাল হেসে বললো-
দোস্তঅনেকদিন তোকে দেখি না। তোকে
দেখতে ইচ্ছে হলো তাইচলে আসলাম।
আজ রাতটা তোরসাথেই কাটাবো। আকাশ
আমারছোট কালের বন্ধু। আমরা একইসাথে
বড়হয়েছি। আমার বাসাথেকে ওর বাসা প্রায়
দু-কিলোমিটার দূরে। অনেকদিন তার
সাথেবিভিন্ন ব্যস্ততার জন্য দেখা করতে
পারি নাই। প্রায় এক মাস হতে যাচ্ছে।
আমার সাথেশুধু মাত্র দেখা করবার
জন্যএতো রাতে সে চলে আসবে বাসায়তা
ভাবতেই পারছি না। এই নাহলে বন্ধুত্ব।
তুই কি বাহিরেইদাড়িয়ে থাকবি? ভিতরে
আস? গল্পকরি দুই বন্ধু মিলে সারারাত।নারে
দোস্ত ঘরে বসবো না। চলবাহির থেকে
ঘুরে আসি। আমিঅবাক হয়ে বললাম- সে
কিরে! এতো রাতে কোথায় যাবি? আর
তুইএতো সাহসী হলী কবে থেকে? কিছুদিন
আগেওনা সন্ধ্যার পর তুই ভূতেরভয়ে বাসার
বাহির হতি না?এখন কি আর সেই দিন
আছে! চল বাহিরে চল। আকাশ একগালহেসে
উত্তর দিলো। আকাশে কি সুন্দর চাঁদ
উঠেছে তাই নারে আকাশ? হু আচ্ছা তোর
হয়েছি কি বলতো? আসবার পর থেকেই
এতোচুপচাপকেন? আকাশ মৃদু হেসে
বললো- না এমনিতেই। এখন থেকে
ভাবছিএকাই থাকবো। সন্ধ্যার সময় ডিসিশন
নিয়েছিলাম। সারারাতছিলামও একা। কিন্তু
এখন খুববেশি ভয় করছিলো তাই
তোকে ডেকে নিয়ে আসলাম। আমিআবারো
অবাক হয়ে বললাম- একা ছিলি, ভয়
করছিলো এগুলোরমানে কি? তুই সারারাত
কোথায়ছিলি? বাড়ির বাহিরে। কেন? বাসা
থেকে কি তোকে বের করে দিয়েছে? নারে
বাহির করে নাই। আর বাহির করবে কেন?
আমি নিজেই বের হয়ে এসেছি।কেন?
আকাশ আমার হাত ধরেবললো- দোস্ত
আমার বাসায় একটু যাবি? আম্মু আমার
জন্য খুবকাঁদছে। আম্মুকে একটু বলে
দিয়ে আসবি আমি ভালো আছি। খুব ভালো
আছি। আমার জন্য যেন কান্নাকাটি না করে।
আমি অবাকহয়ে বললাম- আমিতো
তোরকথাবার্তা কিছুই বুঝতেছি না।কি সব
বলছিস? বাসা থেকেকেন বের হয়ে এসেছিস।
কিহয়েছে? চল তোকে বাসায়দিয়ে আসি?
নারে দোস্ত আজকে আর বাসায়যাবো না।
পরে আরেকদিন বাসায় যাবো। তুই একটু যাবি
দোস্ত।আম্মু খুব কান্নাকাটি করছে। বলেই
আকাশ আমাকেজরিয়ে ধরে কাদা শুরু করলো।
এখন রাতসারে তিনটা। আমি আকাশের বাসার
সামনে দাড়িয়ে আছি। আকাশকে কিছুতেই
আনা যায় নি।ওকে বলেছিলাম তুই গিয়ে
আমার রুমে বসআমি খালাম্মাকে বলে দিয়ে
আসছি আমার কাছে আছিস এবং
ভালো আছিস। সে তাও করে নাই।
রাস্তায়ই দারিয়ে আছে। আমি খালাম্মারসাথে
কথা বলে বাহির হবার পরনাকি আমার
সাথে আমার বাসায় যাবে।কি ঘটেছে কিছুই
বুঝছি না। আকাশের কান্নারজন্য বাধ্য হয়েই
এতো রাতেআকাশের বাসায় আমার আসতে
হয়েছে।আমি নিথর পাথর হয়ে দাড়িয়ে আছি।
খালাম্মা আমাকে জরিয়ে ধরে অঝরধারায়
কাঁদছেন। আমি খালাম্মাকে কি ভাবে শান্তনা
দিবো বুঝতে পারছিনা।আমার কাছে
সবকিছুএলোমেলো মনে হচ্ছে। পুরো
বাড়িজুড়েই কান্নার শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে।
বাড়িতে অনেক মানুষ। পুলিশএসে আকাশের
লাশ নিয়ে যাচ্ছে। আজ সন্ধ্যায় আকাশ
তাররুমে গলায় ফাঁস আটকিয়েআত্মহত্যা
করেছে। আমারআস্তে আস্তে বোধশক্তি
লোপপাচ্ছে। এ আমি কি শুনছি। আমি
তাহলে এতক্ষণ কারসাথে ছিলাম? আকাশই
তো তার বাসায় আমাকে আসতে বললো।
আকাশের লাশটি পুলিশেরগাড়িতে তোলা
হচ্ছে। শেষ বারের মতো আকাশকে
দেখলামআমি। আমার সমস্ত পৃথিবী
দুলেউঠলো। মনে হচ্ছে সবকিছুদুলছে। চোখ
এর সামনে থেকে সবাই আস্তে আস্তে দূরে
সরে যাচ্ছে। আমি আসতে আসতে
অন্ধকারএকটা জগতে হারিয়ে যাচ্ছি। দূরে
কেযেন কান্না করছে। তার মাঝে কেযেন
বলছে- আম্মুকে বলিস, আমিভালো আছি।

ছায়া

কয়েক দিন ধইরা ঘরে খালি ছায়া দেখতাছি মামী । একটু আগে চা বানাইতেছি, তহনও দেখছি। মনে হইল আমার পিছনে কেডা জানি আইসা খাঁড়াইল। ডরে আমার শইলের রোম সব খাঁড়াইয়া গেছে, এই দেহেন মামী। আমি কইলাম এই বাড়িতে আর কাম করুম না। রাবেয়া রান্নাঘর থেকে এক কাপ চা এনে কাপটা ঠক করে টেবিলের ওপর রেখে খানিকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল। নিগার সকালবেলায় ডাইনিং টেবিলে বসেছিল। চায়ের কাপটা টেনে নিতে নিতে ওর কপাল কুঁচকে যায়। রাবেয়া চলে গেলে মুশকিল। পূর্ণিকে একা সামলাতে পারবে না ও।
শফিকুল ব্যবসার কাজে বেশির ভাগ সময়ই ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামেই থাকে। রাবেয়ার বাড়ি চাঁদপুর; আঠারো-উনিশের মত বয়েস, বেশ বিশ্বাসী, হাটবাজার ওই করে, টাকা-পয়সার হিসাব ঠিকঠাকই দেয়। তা ছাড়া রান্নার হাতও ভালো মেয়েটার। আর সবচে বড় কথা হল পূর্ণার সঙ্গে রাবেয়ার চমৎকার অ্যাডজাস্ট হয়েছে। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মেয়েটা কেমন গুটিয়ে গেছে … নিগারের দুশ্চিন্তা ঘন হয়ে উঠতে থাকে। চায়ের স্বাদ বিস্বাদ ঠেকে। তার কারণ আছে। শফিকুল আর পূর্ণিও ছায়া দেখে ।
পূর্ণি গতকাল বলল, “আম্মু, আম্মু আজকে যখন তুমি বাথরুমে গেলে তখন দেখলাম …” “কি দেখলি?”
“লাফ দিয়ে একটা কী যেন ঢুকল ঘরে। ছায়ার মতন। সাদা …” “সাদা? তারপর …” নিগারের বুক ঢিপঢিপ করে। “তারপর ছায়াটা হাঁটল … জান আম্মু, ছায়াটা না ঠিক আব্বুর মতন।“
“আব্বুর মতন মানে?
যাঃ!”
“হ্যাঁ। সত্যি। তুমি বাথরুম থেকে এলে আর ওইটা চলে গেল জানলা দিয়ে।“
“ওহ্ ।“ শফিকুলও ছায়া দেখে বলল । ডায়াবেটিসের ধাত আছে। ভোরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে। দিন কয়েক আগে ভোরবেলায় ছাদে হাঁটছিল । তখন দেখল সাদা একটা ছায়া নারকেল গাছ থেকে টুপ করে লাফ দিয়ে ছাদে নেমে এল। কথাটা নিগারকে বলতেই নিগার বলল, বুঝেছি, আপনি আজই চোখের ডাক্তার দেখান। বলে কোনওমতে ব্যাপারটা সামাল দিয়েছে । (দ্বিতীয় স্বামীকে ‘আপনি’করে সম্বোধন করে নিগার) কিন্তু, ওই ছায়াটা কিসের? সে যাই হোক। ভারি সমস্যায় ফেলে দিল। রাবেয়া এখন কাজ ছাড়ার হুমকি দিলে বিপদে পড়তে হবে। তবে নিগার এও ভাবে যে… এ বাড়ির সবাই ছায়া দেখছে কিন্তু আমি … আমি দেখি না কেন?
আজ সকালে সাধন আচার্য্যকে ফোন করলেন। অনেক দিন পর। নিগার ডিসপ্লেতে পরিচিত নামটা দেখেই ভীষণ অবাক হয়েছে । বলল, হ্যালো, কাকা, আদাপ। আমি তো এখন কুমিল্লা থাকি। সাধন আচার্য্য বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা। তা আমি কুমিল্লাতেই আছি মা। আমি তোমার ওখানে আসছি । তুমি আমায় এখন ঠিকানাটা বল। ওহ্ ! আসুন কাকা। বলে ঠাকুরপাড়ার বাড়ির ঠিকানা বলল নিগার। সাধন আচার্য্য পেশায় তান্ত্রিক জ্যোতিষ। নিগারের প্রথম স্বামী হাসানের পরিচতি। বৃদ্ধ ভালোই তুকতাক জানেন। বিয়ের পর নিগারের নাভীতে ভয়ানক ব্যথা শুরু হয়েছিল। সাধন আচার্য্য সে সময় কী এক মন্ত্রপূতঃ কবজ দিয়েছিলেন। কাইতনে বেঁধে বাহুতে পরা মাত্রই ব্যথা সেরে গিয়েছিল। বৃদ্ধের যে স্পিরিচুয়াল পাওয়ার আছে, সে বিষয়ে নিগারের কোনও সন্দেহও। ছায়ার ব্যাপারটা ওনাকে খুলে বলতে হবে। নিগার অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করে। বৃদ্ধ গুড়ের চা পছন্দ করেন। রান্নাঘরে চা বানাতে ঢুকল নিগার। গুড়ের চা বানিয়ে ফ্লাক্সে ভরে রাখবে। ঘরবাড়ি কেমন শুনশান করছিল। শফিকুল ঢাকায়, ব্যবসার কাজে গিয়েছে, কবে ফিরবে ঠিক নেই। পূর্ণি স্কুলে। রাবেয়া ওকে আনতে গেছে। রোজ অবশ্য নিগারই আনে। আজ শরীরে কেমন আলস্য ভর করেছিল। কিন্ডারগার্ডেনটা অবশ্য কাছেই। তা ছাড়া স্কুলে গেলে ভালোই লাগে নিগারের। মিসেস তৌহিদা রহমান, মিসেস ফাতেমা আখতার, শিপ্রা সেনগুপ্ত -এরা সবাই পূর্ণির ক্লাসমেটের মা, এদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সময়টা বেশ কেটে যায়। পূর্ণি এবার ক্লাস টুয়ে উঠল।
সাধন আচার্য্য এলেন সকাল সাড়ে দশটার দিকে । গাট্টাগোট্টা শক্ত সমর্থ শরীর। পরনে হলদে রঙের খদ্দেরের পায়জামা আর সাদা রঙের ধুতি। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। চোখে কালো ফ্রেমের পুরু লেন্সের চশমা । গায়ের রং শ্যামলা। মাথায় টাক, পিছনের দিকে অবশ্য খানিকটা পাকা চুল আছে । গলায় কালো রঙের কাইতনে শিবের নৃত্যরত ভঙ্গির ছোট একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি। বাঁ হাতের কব্জিতে তামার বালা, ডান হাতের অনামিকায় লাল টকটকে একটি প্রবাল। চিরকুমার বৃদ্ধ থাকেন পাবনার গুরুসদয় আশ্রমে । পোশাক-পরিচ্ছদ বেশ ধোপদুরস্ত। বৃদ্ধের কাছে নিগারের মোবাইল নম্বর আছে। মাঝে-মাঝে ফোন করে খোঁজ খবর নেন। আজই অনেকদিন পর ফোন করলেন। বেঁচে থাকতে হাসান একবার বলেছিল … এ দেশে যারা তান্ত্রিক জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা করে সাধন আচার্য্য তাদের গুরু। আগে নাকি গুরু ছিলেন লালমাই পাহাড়ের নারায়ণ শিবশাস্ত্রী। ইনিই সাধন আচার্য্যর গুরু। তাঁর মহামন্ত্রপূতঃ তুলসী নাকি মহা রক্ষাকবজ। এমন কী মৃতের জীবনও দান করতে পারে- নারায়ণ শিবশাস্ত্রীর ভক্তদের মধ্যে এমন বিশ্বাস নাকি প্রচলিত ছিল।
সাধন আচার্য্য কে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে চা দিয়েছে নিগার। গুড়ের চা দেখে উৎফুল্ল বৃদ্ধ। চায়ে চুমুক দিয়ে বৃদ্ধ বললেন, মা, অনেক দিন হল তোমাকে দেখি না, তাই ভাবলাম এদিকে যখন এসেছি মায়ের সঙ্গে একবার দেখা করেই যাই। কুমিল্লায় কোথায় এসেছিলেন কাকা? চায়ে চুমুক দিয়ে সাধন আচার্য্য বললেন, লালমাই পাহাড়ে মা। সদাশিব মোহান্ত নামে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর কাছে। বিচিত্র ধরণের একটি নাগিনী সাপের নীলাভ নাগমনি নাকি তিনি সংগ্রহ করেছেন, তাই আমাকে একবার দেখাতে চাইলেন। দেখলেন?
হ্যাঁ। বড় আশ্চর্য জিনিস। নীল রঙের। পুরাণে নাগমনির কথা পড়েছি এটির কথা। কিন্তু বাস্তবে যে আছে তাই জানতাম না। সে যাক। আজকাল আমি আবার ঘন ঘন হাসানকে স্বপ্ন দেখছি। আহ্, ছেলেটি আমাদের ছেড়ে অকালে চলে গেল। মহেশ্বর কার কপালে যে কী লিখে রেখেছেন। ছোট থাকতে প্রখর স্মরণশক্তির অধিকারী ছিল হাসান। জান তো, আমাদের বাড়ি একই পাড়ায় ছিল। জানি কাকা। আঁচলে চোখ মুছে নিগার বলল। এই মুহূর্তে বৃদ্ধ জ্যোতিষীর মুখটা কেমন যেন ঝাপসা দেখাচ্ছে। আমিই ওকে এসরাজে হাতেখড়ি দিয়েছি … ও যখন রাগ পটদীপ বাজাত …আহ! নিগার চুপ করে বসে থাকে। হাসানের প্রসঙ্গে চোখে জল আসে। হাসানের বাবার যখন যশোরে পোস্টিং ছিল, সে সময় সাধন আচার্য্য হাসানদের প্রতিবেশি ছিলেন। হাসানকে খুব স্নেহ করতেন বৃদ্ধ। হাসানের বাবা যশোর থেকে বদলী হয়ে গেলেও বৃদ্ধ সর্ম্পক রেখেছেন। বৃদ্ধ অনেকবারই এসেছিলেন ফকিরহাটের বাড়িতে । তবে একটা কথা মা। সাধন আচার্য্য বললেন। জ্বী কাকা, বলুন । হাসান … হাসান ঠিক মারা যায়নি মা।
নিগার চমকে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলল, কি …কি আপনি কি বলছেন কাকা! হাসান মারা যায়নি মানে? উত্তর না দিয়ে সাধন আচার্য্য চায়ে কাপে চুমুক দিলেন। তারপর কাপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন। ফ্লাক্স থেকে গুড়ের চা ঢেলে নিচ্ছেন। জানালা দিয়ে রোদ ঢুকেছে ঘরে। বৃদ্ধের মুখোমুখি একটি সোফায় সিদে হয়ে বসে থাকা নিগার কাঁপছিল। বৃদ্ধের দিকে অপলক চোখে চেয়ে আছে। কখন যে বলে উঠল, কি বলছেন কাকা হাসান মারা যায়নি? নিগারের কন্ঠস্বর কেমন দূর্বল শোনায়। হাসানের মরদেহ পাওয়া গেছে? বৃদ্ধ পালটা প্রশ্ন করলেন। নিগারের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছেন। না কাকা। তাহলে?
নিগারের শরীরের শীতল স্রোত ছড়িয়ে পড়ে। পলক না ফেলে বৃদ্ধকে দেখছে। বৃদ্ধ ঠিকই বলেছেন। অ্যাক্সিডেন্টের পর হাসানের ডেডবডি পাওয়া যায়নি। হাসান ছিল উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা। ফকিরহাট উপজেলায় পোস্টিং। সুভাড্যা থেকে রামপাল যাবার পথে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়। কালভার্ট ভেঙে বাস খালের মধ্যে পড়ে যায়। না, হাসানের লাশ পাওয়া যায়নি। হাসানের সহকর্মী শহীদুল আলম হাসানের সঙ্গেই একই বাসে ছিলেন। সেটি তিনি কনফার্ম করেছেন। শহীদুল আলমও দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তাহলে? নিগারের কপালে ঘাম ফুটে উঠছিল।নিঃশ্বাস দ্রুতগামী হয়ে উঠেছে। হাসান …হাসানকে ও ভুলতে পারেনি। সুন্দর একটা মন ছিল ওর। ওর এসরাজটা এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছে। হাসান মেয়েটাকে প্রচন্ড ভালোবাসত। হাসান যখন মারা গেল সে সময় পূর্ণির বয়স পাঁচ। কীভাবে যে নিগার একা সামলেছে সেই কঠিন শূন্যতায় ভরা দিনগুলি।
নিগারের বাবা ফকিরহাট এসে মেয়েকে নরসিংদী নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক চট্টগ্রাম রেলওয়েতে চাকরি করলেও নরসিংদীতে জমি কিনে টিনশেডের বাড়ি করেছিলেন। তিনিও এক বছরের মাথায় মারা গেলেন। স্ট্রোক করেছিলেন। হয়তো মেয়ের নিস্করুণ বৈধব্যে রূপ দেখেই … নিগারের অথই সমুদ্রে ভাসছিল। মাথার ওপর অবিভাবক না থাকলে যা হয় …অনেকটা আকস্মিৎ ভাবেই নিগারের বড় চাচা কুমিল্লার এক বিপত্নিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে নিগারের বিয়ে ঠিক করেন। দ্বিতীয় স্বামী শফিকুল ইসলাম ভালো মানুষ। (তবে ভীষণ কাজপাগল … সংসারে মন নেই, এ কারণেই হয়তো হাসানের এসরাজ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেন নি) কুমিল্লা শহরে কান্দিরপাড়ে প্রেস আছে। ঠাকুরপাড়ায় চারতলা বাড়ি। মাস গেলে প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকা ভাড়ার টাকা নিগারের হাতেই জমা হয় । ভিতরে ভিতরে হাসানের জন্য মন পুড়লেও দ্বিতীয় স্বামীর সংসারে নিগারের অন্তত সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য আছে। এখন বৃদ্ধ তান্ত্রিক জ্যোতিষী এসে কী কথা শোনালেন? সাধন আচার্য্য বললেন, আমি তোমার কাছে একটা জরুরি কথা বলতে এসেছি মা। বলেন কাকা। বলে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিল নিগার। বুকটা ঢিপঢিক করছে। ভোরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময় শফিকুলও ছায়া দেখেছে । ছায়াটা নারকেল গাছ থেকে টুপ করে লাফ দিয়েছিল। আসলে কি ছিল ওটা? এক তীব্র কৌতূহল আচ্ছন্ন করে নিগারকে। সাধন আচার্য্য পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট একটি নকশাদার রুপোর ঢিবে বের করলেন। তারপর সেটি খুলে এক টিপ খইনি বার করে মুখে ফেললেন । বাতাসে শুকনো তামাকের গন্ধ ছড়ায়।
খইনি চিবুতে চিবুতে বৃদ্ধ বললেন, তুমি কি ঘরে ছায়া দেখ মা?
ছায়া? হ্যাঁ, ছায়া। ধূসর ছায়া। নিগারের শরীর কাঁপছে। না কাকা, ছায়া আমি দেখি না। তবে আমার স্বামী, কাজের ঝি আর আমার মেয়ে দেখে। এ নিয়ে আমি ক’দিন ধরে ভীষণ টেনশনে আছি কাকা। হুমম। আমি কিন্তু ছায়া দেখি না কাকা। তোমাকে একটা মন্ত্রপূতঃ কবজ দিয়েছিলাম না মা?
হ্যাঁ, কাকা।
ওটা কি তুমি এখনও বাহুতে ধারণ কর?
হ্যাঁ, কাকা। এই যে। বলে ক্লালো রঙের ব্লাউজের হাতা সামান্য তুলে কালো কাইতন দেখাল নিগার।
সাধন আচার্য্য মাথা নেড়ে বললেন, বুঝতে পেরেছি। ওই জন্যেই …
কিন্তু, কিন্তু, ছায়ার কথা আপনি জানলেন কী ভাবে কাকা?
শোন মা, আমি দীর্ঘদিন যাবৎ জগতের আদি-রহস্যের সন্ধানে ব্রতী হয়েছি। তারা মায়ের আরাধনা করছি। শিবত্ম অর্জনের জন্য যোগসাধনা করছি। ভূ-ভারতে কত তান্ত্রিক- কাপালিকের সঙ্গে গূহ্য শাস্ত্র আলোচনা করেছি। তন্ত্রসাধনা করলে এসব জানা কঠিন কিছু বিষয় নয় মা। তন্ত্র আসলে বিজ্ঞান। অপরা বিজ্ঞান।
ওটা ওটা কিসের ছায়া কাকা?
হাসানের ছায়া মা।
হাসানের মানে??? নিগারের মাথা টলে উঠল। হাসান এখনও ছায়া হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে আছে। নিগারের শ্বাস
আটকে যায় প্রায় । ও অস্ফুটস্বরে বলল, হাসান ছায়া হয়ে আছে মানে? আপনি কী বলছেন কাকা?
সাধন আচার্য্য খইনি চিবুতে ভুলে গেছেন যেন। চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে আছেন। জানালা দিয়ে রোদ পড়েছে চৌকো মুখের ওপর। মসৃণ টাক চকচকে দেখায়। কপালের বাঁ পাশেকালো রঙের জন্মদাগ। মাঝখানে একটি আঁচিল। হঠাৎ চোখ খুলে বৃদ্ধ বললেন, হ্যাঁ, মা। বাস দূর্ঘটনায় আঘাত ওর মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল না। আবার আগের মতন বেঁচে থাকাও সম্ভব ছিল না। তান্ত্রিক গূহ্যশাস্ত্র অনুযায়ী এমন অবস্থায় মানুষ যথার্থ লোকে যেতে পারে না,কায়া তখন ছায়ায় রুপান্তরিত হয়। হাসান এখন ছায়া হয়ে রয়েছে। এই ছায়াজীবন খুব কঠিন মা। খুব যন্ত্রণা পাচ্ছে ছেলেটা। বলতে বলতে বৃদ্ধের মুখ কুঁকড়ে গেল । কপালে ভাঁজ পড়ল। বৃদ্ধ হাসানকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ওই দেখ। সাধন আচার্য্য হাত তুলে বললেন। নিগার চট করে ডান পাশে ফিরে তাকায়। পর্দার ওপাশে কী যেন সরে যায় । দ্রুত। কালো মতন। নিগারের শরীর ঝনঝন করে বেজে ওঠে।
কী ওটা?
বৃদ্ধ কিছু বলার আগেই টুং টাং ডোরবেল বাজল। নিগার চমকে ওঠে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কেমন ঘোরের মধ্যে দরজার কাছে চলে আসে। বুক ভীষণ ধড়ফর করছে। দরজা খুলে দেখল রাবেয়া, হাতে স্কুলের ব্যাগ আর পানির বোতল। কিন্তু, পূর্ণি কই? নিগারে বুক ধক করে উঠল। মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল, কি রে! পূর্ণি কই? রাবেয়া হাসে। ঠিক তখনই পিছনে পূর্ণি বেরিয়ে আসে, স্কুল ড্রেস পরা, হাসছে। রোদে ঘেমে গেছে। ছোট ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। অন্য সময় হলে মেয়েকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে। আজ আর আদর করতে ইচ্ছে করছিল না। নিগার বলল, যাও মা, এখন গোছল করে নাও। পূর্ণি একবার সাধন আচার্য্যর দিকে তাকিয়ে চলে যায়। মনে হল না বৃদ্ধকে দেখে খুশি হয়েছে। বৃদ্ধও যেন পূর্ণি কে দেখে চমকে উঠলেন।
নিগারের একবার মনে হল যে পূর্ণিকে বলে, সালাম দাও। তোমার মনে নেই? দাদু। কী মনে করে সামলে নিল। তার বদলে রাবেয়া কে বলল, পূর্ণির গোছল শেষ হলে ওকে ফ্রিজ থেকে স্যুপ বের করে গরম করে খেতে দিবি। আইচ্ছা। বলে রাবেয়া চলে যাবে। নিগার আবার বলল, শোন, এখন ডিপ থেকে রুইমাছ করে ভিজিয়ে রাখ। দুপুরে মেহমান খাবে । রাবেয়া চলে যায়। নিগার সোফায় এসে বসল। ওর মোবাইলটা পাশে পড়ে আছে, সোফারওপর। পরিচিত নকিয়ার রিং টোন বেজে উঠল। নিগার মোবাইল তুলে নিয়ে বলল, হ্যালো।
কার সঙ্গে যেন ক্ষাণিক ক্ষণ কথা বলল। ওর মুখের ভাব কেমন বদলে যেতে থাকে। একটুপর ফোন অফ করে সাধন আচার্য্যর দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে নিগার বলল, ফোন করেছিলেন হাসানের সহকর্মী শহীদুল আলম । ইনি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা। ফকির হাটে আমরা পাশাপাশি ছিলাম। এখন অবশ্য ভদ্রলোকের পোস্টিং মনিরামপুর উপজেলায়। আচ্ছা। শহীদুল
আলম অ্যাক্সিডেন্টের সময় হাসানের সঙ্গে একই বাসে ছিলেন।
আচ্ছা। তা কি বলল সে?
বললেন যে, কিছুদিন ধরে তিনি নাকি ছায়া দেখছেন। ছায়াটা কখনও মানুষের আকৃতি নেয়। তখন অনেকটা হাসানের মতো দেখায়। ওহ্ । তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ছায়া আমিও দেখি কিনা। তা কি বললে তুমি? আমি বললাম না আমি ছায়াটায়া দেখিনা। খামাখা ওনাকে আতঙ্কগ্রস্থ করার কী লাভ বলেন?
তুমি ঠিকই বলেছ মা।
কিন্তু … কিন্তু এখন কী করব আমি কাকা?
ভাবছি।
নিগারের মোবাইল ফোন বাজল। মিসেস ফাতেমা আখতার। পূর্ণার ক্লাসমেট ফারিয়ার মা। রানির বাজার এলাকায় থাকে। ভদ্রমহিলার স্বামী সেলিম আখতার কুমিল্লা শহরের একজন প্রথম সারির ব্যবসায়ী। জ্বী আপা, বলেন। নিগারের গলা কাঁপছিল। আপা, আজ তো ফারিয়ার জন্মদিন। আপনার মেয়েকে আমি আমার বাসায় নিয়ে এসেছি। দুপুরে খাইয়ে আমার গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দেব। আপনার মেইডকে আমি বিদায় করে দিয়েছি। ও আপনাকে বলেনি। আপনি ফোন করলেন না বলে আমিই ফোন করলাম। আপা প্লিজ ওকে আবার আপনি বকাঝকা করবেন না যেন … ওহ্ নো। নিগারের হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায় মেঝের কার্পেটের ওপর।
কী হল মা? সাধন আচার্য্য ঝুঁকে পড়লেন। পূর্ণি আমার মেয়ে …ও … ও…অন্য কেউ … ও আমার মেয়ে না … নিগারের কন্ঠস্বর ফুটছিল না।
হ্যাঁ, সেটা তখনই বুঝেছি।
বলে দ্রুত পায়ে দরজার কাছে চলে এলন সাধন আচার্য্য। পিছন পিছন নিগার। ওর দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। মাথা কেমন টলছে। খাওয়ার ঘরে কেউ নেই। ওরা রান্নাঘরে দিকে যায়। রাবেয়া চুলার সামনে। চুলায় একটা সসপ্যান । সুপ গরম করছে মনে হল। পূর্ণি কই? নিগারের কন্ঠস্বর কেমন খসখসে শোনালো। গোছলখানায় মামী। রাবেয়া ফিরে তাকিয়ে বলল। নিগারের মুখ দেখে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। নিগার প্রায় দৌড়ে বেডরুমে চলে আসে। পিছনে সাধন আচার্য্য। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। বিড়বিড় করে কী যেন জপছেন। কেটে হাত দিয়ে রক্ষাকবচটি দেখে নিলেন। নিগারের আঁচল খসে পড়েছে। সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। বেডরুমে কেউ নেই। বাথরুমের দরজা বন্ধ। তবে ভিতর পানির কিংবা সাড়াশব্দ শোনা যাচ্ছে না। নিগার দরজার কাছে গিয়ে বলে, অ্যাই পূর্ণা, পূর্ণা। কি করছ তুমি?
ভিতর থেকে একটি পুরুষ কন্ঠ বলল, আমি গোছল করি।
নিগার সাধন আচার্য্যরে দিকে তাকালো। ফিসফিস করে বলল, হাসানের গলা। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। বললেন, তাকে জিগ্যেস করো তো, সে কি চায়?
হাসান কি চাও তুমি? নিগারের গলা কাঁপছিল।
আমি ফিরে যেতে চাই …
কোথায়?
মৃত্যুর পরে মানুষ যেখানে যায়।
সেখানে যাও না কেন?
যেতে পারছি না যে!
কেন যেতে পারছ না?
আমি যে বেঁচে আছি। আমি যে মরিনি।
নিগার সাধন আচার্য্যর দিকে তাকালো। ওর চোখে মুখে অসহায় ভাব। সাধান আচার্য্য পাঞ্জাবির পকেট থেকে কী একটা বের করলেন। তারপর উবু হয়ে বসে জিনিসটা বাথরুমের দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন। তখনই ভিতর থেকে ভয়ঙ্কর চিৎকার শোনা গেল। যেন এক হিংস্র শ্বাপদ ভয়ানক আক্রোশে ক্রদ্ধ গর্জন করছে। যে সব ভেঙেচুরে ফেলবে সে। নিগার থরথর করে কাঁপছিল। চিৎকার শুনে রাবেয়া রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছে। এই মুহূর্তে নিগারকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সাধন আচার্য্য বিড়বিড় করে মন্ত্র জপছেন। একটু পর ক্রদ্ধ গর্জন থেমে গেল। নিগারকে ভয়ানক ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ও ফ্যাঁসফ্যাঁসে স্বরে জিগ্যেস করল, ওটা … ওটা কি ছিল কাকা? তখন দরজার তলা দিয়ে কী দিলেন?
সাধন আচার্য্য মৃদু হেসে বললেন, মহামন্ত্রপূতঃ তুলসী মা। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে আমার গুরু স্বর্গীয় নারায়ণ শিবশাস্ত্রী দিয়েছিলেন । বলে দু’হাত জড়ো করে কাকে যেন প্রণাম করলেন। তারপর বললেন, মহামন্ত্রপূতঃ তুলসী এক মহা রক্ষাকবজ মা। বলে বাথরুমের দরজায় কাঁধ দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলেন সাধন আচার্য্য। বৃদ্ধ হলেও প্রত্যহ যোগসাধনা করেন বলে শক্ত সমর্থ মানুষ । দরজার ছিটকিনি খুলে যায়। ভিতরে কেউ নেই।
অমাঃ। মামী! পূর্ণায় গেল কই?
রাবেয়া আর্তচিৎকার করে ওঠে। লাল প্লাস্টিকের বড় বালতিটা ওলটানো। মেঝের ওপর পানি। মগটাও মেঝেতে পরে আছে। ওপাশের দেয়ালে গভীর ফাটল, ওপরের ছোট জানালার কাঁচ ভাঙা। হু হু করে রোদ ঢুকেছে। তোমার মেয়ের একবার খোঁজ নাও তো মা। স্নিগ্ধকন্ঠে সাধন আচার্য্য বললেন। বৃদ্ধ ঘেমে গেছেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিলেন। মোবাইলটা ড্রইংরুমের মেঝের ওপর পড়ে ছিল। নিগার দৌড়ে ড্রইংরুমে আসে। তারপর মিসেস ফাতেমা আখতারকে ফোন করে ।
হ্যালো, আপা, পূর্ণির কি খাওয়া হয়ে গেছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ। ও এখনি রওনা দেবে। আপনার মেয়ে তো কিছুই খেল না আপা। এত কষ্ট করে কাশ্মীরী পোলাও আর টমেটো চিকেন করলাম, আপনার মেয়ে ছুঁয়েও দেখল না, ডিমের মিহিদানাও না, আমার শ্বশুরবাড়ির রসভরি পিঠাও না । যা একটু ওই আপেলের সালাদ খেল …

সাহেব বাড়ি


বছর ১২-১৪ আগের এই ঘটনা। আমরা, অর্থাৎ আমি, আমার স্ত্রী নীলা আর আমার মেয়ে রুচিকা, এক শিতের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম দার্জিলিং। এক সপ্তাহের ছুটি কাটিয়ে আমরা নেমে আসছিলাম শিলিগুড়ির দিকে। পাহারের কোল ঘেঁসে আমাদের গাড়ি দ্রুত নেমে চলেছে সরু পাহাড়ি রাস্তা ধরে। রাস্তার পাশে পাহারের ঢাল ধরে শালবন আর তার মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট শহর, গ্রাম আর চা বাগানের এস্টেট। গারির নেপালি চালক বাহাদুর সিং নিপুণ হাতে আমাদের গাড়ি দুর্গম রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলেছেন। আমরা দার্জিলিং থেকে দুপুরের খাওয়া শেরে বেরিয়েছি। পথ চলতে ৩ ঘনটার বেশি লাগবে না – বিকেল ৪টের মধ্যে শিলিগুড়িতে পৌঁছে যাওয়া উচিত।

বাহাদুরের পাশে সিটে বসে আমি পথের শোভা উপভোগ করে চলেছি। গারির ঘড়িতে তখন বাজে ৪টে।রাস্তায়ে একটু আগে দেখলাম আমাদের সামনে অন্য গারি গুল আটকে গেছে। গাড়ি থামিয়ে খোজ নিয়ে জানা গেল যে ধ্বস নেমে সামনে রাস্তা বন্ধ হয়েছে। সৈনিক বাহিনীর লোক লাগিয়ে পথ পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু ষে কাজ কতক্ষণ লাগবে কেউ তা সঠিক জানে না।বাহাদুর আর নীলার সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে পিছনে ফেলে আশা মকাই-বারির দিকে ফিরে জাব। সেই পথে আসতে কিচ্ছু চা বাগানের বাংলো নজরে পড়েছিল। আমরা ঠিক করলাম যে আজ রাতটা চা বাগানের ডাক বাংলোয়ে কাটিয়ে পরের দিন সকাল বেলা ফের রওনা হব।

অল্প রাস্তা আবার গাড়ি চলল পাহাড় বেয়ে উপর দিকে। মকাই বারি থেকে কিছু আগে একটা ছোটো এস্টেট দেখে আমাদের গাড়ি বড় রাস্তা ছেরে কাচা রাস্তা ধরল। চা বাগানের ভিতর দিয়ে অল্প দূর এগতেই চোখে পরল কিছু অফিস বারি – একটু পৃথক একটা সুন্দর এবং বেশ পুরনো কাঠের বাংলো বাড়ি। বাংলোটা জমি থেকে অল্প উঁচুতে, যেরকম পাহাড়ি অঞ্চলের বাড়ি হয়ে। চার পাশ ঘিরে চওড়া বারান্দা রয়েছে। বারিটার মাথাতে টালির ছাদ, এক কালে হয়ত লাল রঙ ছিল, এখন অনেক জায়গাতে শ্যাওলা পরে গেছে। ছাদের মাঝা মাঝি একটা পুরনো পাথরের চিমনি উঠে গেছে, যেটা দিয়ে অল্প ধুয়ও বেরচ্ছে। বারির পেছনে একটা ছোটো বাগান দেখতে পেলাম। তার তিন ধার পাহাড়ি ঝোপ দিয়ে ঘেরা। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এই বাংলোটি ভালই দেখা শুনা হয়। আমরা গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বারির সামনের বারান্দা থেকে নেমে এসেছেন। তার সাথে আলাপ করে জানলাম তিনি এখানকার কেয়ারটেকার – নাম হরিনাথ বাবু। তিনে জানালেন যে ঘরটি আপাতত খালি আছে এবং আমরা এক রাতের জন্য সেখানে থাকতে পারি। গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে আমরা বাড়িটাতে প্রবেশ করলাম। বারির ভেতরটা পুরনো ধাঁচে সাহেবি কায়দায়ে সাজানো। ঢুকে বসবার ঘর এবং খাবার ঘর দুটোই বেশ বড়। সঙ্গে লাগোয়া রান্নার ঘর আর এক পাশে দুইটা শোবার ঘর।বসবার ঘর থেকে পেছনের বারান্দায়ে বেরনোর জরা কাচের দরজা।ঘরের আসবাব পত্র দেখে বেশ অনুমান করা যায় যে এই বাড়ি যিনি বানিয়েছিলেন তিনি ছিলেন শৌখিন রুচির মানুষ।

আমরা আমাদের জিনিসপত্র শোবার ঘরে তুলে পেছনের বারান্দাতে একটা বেতের সোফা সেটে গিয়ে বসলাম।হরি বাবু চায়ের আয়োজন করেছেন। পাহাড়ি এলাকায়ে অন্ধকার চট করে পরে যায়। আমরা সেই বারান্দায়ে বসে সূর্য ডোবা দেখতে লাগলাম। সামনে ছোট্ট সুন্দর সাজানো বাগান।বাগানের চার পাশে অনেক রকম ফুলের গাছ। মাঝখানে একটা পুরনো পাথরের ফোয়ারা – সেটা থেকে অনেক দিন জল বেরনো বন্ধ হয়ে গিয়েছে মনে হল। একটা সরু পাথর বাধানো পায়ে চলার পথ বারান্দা থেকে নেমে এই ফোয়ারা প্রদক্ষিণ করে বাগানের পেছন দিকে ঘুরে গেছে। বাগানের তিন দিক পাহাড়ি ঝোপ দিয়ে ঘেরা। ঝপের ওই ধারে চা বাগান শুরু। যত দূর চোখ যায় পাহারের ঢাল ধরে সবুজ চা গাছের বাগান বহু দূরে কালচে নীল তেরাই শালবনের সাথে মিশে গেছে।

চা খেয়ে আমরা বাগানের পথটা দিয়ে অল্প এগলাম। পাথরের ফোয়ারাটা পার হয়ে পথটা বেকে গেছে একটা গন্ধরাজ কাঠগোলাপ গাছের গাঁ ঘেঁষে। সেই দিক্টায়ে দেখি রুচিকা পথের ধারে দারিয়ে কিছু যেন মন দিয়ে দেখছে। কাছে গিয়ে দেখি একটা ছোটো সমাধি। সমাধিতে তিনটে কবর। প্রায় গাছগাছড়ায়ে ঢেকে গেছে। নজর করে পাথরের গায়ে খোদাই করা লেখা পরলাম।

In Memory of :: Mary Anne Stuart :: 1926 -1960

In Loving Memory of our daughter :: Rebbecca Stuart :: 1950-

RIP :: Charles Stuart :: 1921-1960

বুঝতে অসুবিধে হল না, যে এরা সবাই একটা পরিবারের। বোধহয়ে বাবা, মা, মেয়ে – মনে প্রশ্ন জাগল – রেবেকার কবরের গায়ে শুধু জন্ম তারিখটাই দেওয়া আছে কেন? মনটা খারাপ হয়ে গেল, দূর বিদেশে তাদের জীবন কাহিনীর সমাপ্তি হয়েছে অল্প সময়ের ব্যবধানে মাত্র এক বছরের মধ্যে। এক অচেনা অজানা ছায়া নেমে এলো আমার মনে। এদিকে সূর্য অস্ত গেছে পশ্চিমের পাহারের পিছনে। দিনের আল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আমরা আবার বাংলোর ভিতর ফিরে এলাম।

রাতের খাবারের বেশ ভালই আয়োজন করেছিলেন হরি বাবু। মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে আমরা ফায়ার প্লেসের সামনে বসে গল্প করলাম কিছুক্ষণ। হরি-বাবুও যোগ দিলেন আমাদের সাথে। বাহাদুর সিং তার খাবার নিয়ে আগেই চলে গেছে – ষে রাতে গড়িতেয়ই শোবে।কিছু পরে রুচিকা একটা গল্পের বই নিয়ে নিজের ঘরে শুতে চলে গেল। রুচিকার বয়স তখন দশ। এখানে পউছন থেকে ওকে খুব চুপচাপ মনে হচ্ছে। যেন কিছু চিন্তা করছে। একটু পরে নীলা হাই তুলে উঠে পরল। নীলা যাবার পর আমি হরি-বাবুর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। তার থেকেই জানতে পারলাম বাগানে দেখা সমাধির ইতিহাস।

দেশ স্বাধীন হবার পরেও বাগানের মালিকানা ছিল সাহেবি হাতে। ১৯৫০ শালে এই বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসেন চার্লস স্টুয়ারট তার সঙ্গে আসেন নতুন মেমসাহেব পত্নী মেরি অ্যান। আসার এক বছরের মধ্যেই তাদের এক সন্তান হয়ে। এই বাগানেই জন্মায়ে ফুটফুটে মেয়ে রেবেকা। তার পরের কয়েক বছর খুব সুখে কাটে এই ছোট তিন জনের পরিবার। ছোট রেবেকা বেরে ওঠে ওই বাগানে। বাগানের সবাই তাকে স্নেহের চোখে দেখে। বাবা মার ষে চোখের মনি।

তবে প্রকৃতির নিয়ম – কোন কিছুই চির স্থায়ী নয়।এই সুন্দর সংসার ও এই নিয়মের গণ্ডি রেখায় সীমা বধ্য। এক দিনের ঘটনা এই ছোটো পরিবারের শান্তির পটচিত্র ছিরে দিল। রেবেকার ছিল দুরন্ত ডানপিটে স্বভাব – একাই বেরিয়ে ঘুরত চা বাগানে ঘড়ায়ে চেপে। এক দিন দুপুর বেলায়ে রজের মতো ষে ঘোড়ার পিঠে ঘুরতে বেরাল। ঘণ্টা খানেক পরে তার ঘোড়া ফিরে এল কিন্তু রেবেকা ফিরল না। সাহেব দল বল নিয়ে কানায়ে কানায়ে পাহাড় জঙ্গল তল পার করে খুঁজলেন, কিন্তু কোন লাভ হল না। রেবেকা কে আর কোন দিন কেউ খুঁজে পেল না। ওই বাগানের কনা তেই রেবেকার স্মৃতিতে একটা সমাধি বানালেন সাহেব।এই ধাক্কা মেরি-আয়ন সামাল দিতে পারলেন না। রেবেকা কে হারানর পরেই তিনি শোকে শয্যা শাই হয়ে পরলেন।ধীরে ধীরে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকল। কলকাতা থেকে ডাক্তার আনিয়ও তাকে বাচাতে পারলেন না সাহেব। শেষ পর্যন্ত সবাই বুঝতে পেরেছিল মেমসাহেবের কষ্ট শরীরের নয় মনের। এক দিন রাতে শুতে গিয়ে সকাল বেলা তার আর ঘুম ভাঙল না। রেবেকার সমাধির পাসেই নিজের স্থান করে নিলেন মেরি-আয়ন।

এর পরে চার্লস সাহেবের মধ্যে একটা পরিবর্তন নজর করলে সকলে। যে লকটা সবার সাথে হেসে কথা বলত, জাকে সব বন্ধু রা ভালবাসত, যাকে তার কর্মচারীরা শ্রদ্ধা করত, সেই মানুষটা রাতারাতি পাল্টে গেল। রোজ দুপুরের পর থেকেই মদ খেতে শুরু করলেন। লকজনের সঙ্গে মেলা মেশা বন্ধ করে দিলেন একদম। বাগানের লোক ও বারির কাজের লোকেরা দেখলও যে সাহেবের চোখে মুখে একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে। সন্ধ্যার পর থেকে তিনে বসে থাকতে শুরু করলেন বাগানের দিকে মুখ করে পেছনের বারান্দায়ে। নিজের আর মদের গ্লাস নিয়ে নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলতেন। লোকে তাকে ভয়ে পেতে শুরু করল। এরকম বেশি দিন চলল না। একদিন ভরে গুলির আওয়াজ শুনে ছুটে বেরিয়ে এল মালী আর রান্নার লোক। তারা দেখলও সাহেব নিজের জাওয়ার সময়ে নিজেই বেছে নিয়েছেন।বারান্দায়ে তার লাশ পরে আছে। নিজের পিস্তলের গুলিতেই নিজের প্রাণ নিয়েছেন চার্লস স্টুয়ারট।

রাত দশটা নাগাত শুতে গেলাম। বাইরে অল্প বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘরে দেখি নীলা গভীর নিদ্রায়ে – আমি তার পাশে কম্বল মুরি দিয়ে শুলাম। বেশ শীত, সারা দিনের খাটা খাটনির পর সহজেই ঘুমিয়ে পরলাম।

ঠিক কখন বা কেন ঘুম ভাঙল বলতে পারব না। কিন্তু একটা সময়ে আমি সজাগ। পরদার ফাঁক দিয়ে ঘরটায়ে অল্প চাদের আল ঢুকছে। বুঝতে পারলাম বৃষ্টি থেমে গেছে। পাশে টের পেলাম নীলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমার মনে হল যেন বসবার ঘর থেকে আমি কিছু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। বিছানা ছেরে উঠে পরলাম – দরজা পেরিয়ে গেলাম বসবার ঘরে। ষে ঘর তখন নিঝুম – ফায়ার প্লেসের আগুন নিভে ছাই হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরটাতে জ্যোৎস্নার আলো পরেছে। বারান্দার দরজা হাট করে খোলা। খটকা লাগল – তাহলে কি শোবার আগে হরিনাথ বাবু বন্ধ করতে ভুলে গেছেন? দরজাটা বন্ধ করতে জাব, তখন দেখলাম রুচিকার ঘরের দরজাটাও ভেজান নয়। অল্প হাওয়াতে সেটা সামান্য খুলে গেছে। তার দরজা বন্ধ করতে গিয়ে আমার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এলো। আমি দেখলাম রুচিকার বিছানা খালি।

মুহুরতের জন্য একটা বরফের ছুরি আমার বুকটা চিরে দিল। তারপরে নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম পিছনের বারান্দায়ে। বাগানে চারিদিক নিস্তভধ – জ্যোৎস্নার সাদা আলোতে সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ওই মাঝরাতে সেই বাংলর বাগানে আমি রুচিকাকে দেখলাম। রুচিকা বসে আছে পাথরের ফোয়ারাটার পাশে। ষে একা নয় – ওর পাশে বসা ওরই বয়সী এক ছোটো মেমসাহেব কন্যা। আমার বুকের ভেতর জমা বরফটা চূর্ণ হয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি ছুটে গিয়ে রুচিকাকে নিয়ে আস্তে চাইলাম, কিন্তু আমার সারা শরীর যেন অসার। টের পেলাম আমার পিছনে কেউ আছে – নাকে একটা চুরুটের গন্ধ এলো। ঘুরে তাকিয়ে দেখি বারান্দার কোনায়ে বেতের চেয়ারে বসা এক সাহেব। আঙ্গুলের ফাকে চুরুট, সামনে টেবিলে মদের বোতল। স্থির চোখে আমার দিকে চেয়ে আছেন। হাতের ইশারায়ে আমায় ডাকলেন। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম। বসলাম তার পাশের সাফায়।

একটু হেসে সে বললে, “ওদের এখন ডেকো না, একটু খেলতে দাও। আমার মেয়েটা বড় একা”।

চুরুটের ধোয়ার গন্ধে আমার মাথা ঘুরতে থাকল। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল।

যখন আমার জ্ঞান ফিরল তখন সকাল। হরি বাবু আমাকে ঝাঁকাচ্ছেন।

“আরে আপনি তো মশাই চিন্তায়ে ফেলে দিয়েছিলেন – ঠিক আছেন তো”? আমার তখন ঘোর কাটেনি, উত্তর দিতে পারলাম না। “সারা রাত এই বারান্দায়ে কাটালেন বুঝি – এরকম করে আপনার ঠাণ্ডা লেগে যাবে” বেশ করা শুরে আমায়ে শোনাতে শুরু করলেন হরি বাবু।

আমার গত কাল রাতের সব কথা মনে পরে গেল। হরি বাবুকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম – “রুচিকা কথায়ে”? ছুটে গেলাম রুচিকার ঘরে, ওর ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। রুচিকা ওর বিছানায়ে সুয়ে ঘুমচ্ছে। সব কিচ্ছু মাথার ভেতর গণ্ডগোল হয়ে গেল। কাল রাতে কি আমি পুরটাই স্বপ্ন দেখেছি।

এর পর আর গল্প বিশেষ বলার নেই। বাহাদুর সিং এসে খবর দিল রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সকালের খাওয়া সেরে, মালপত্র গারিতে তুলে আমারা যাত্রার প্রস্তুতি করছি। আম্বাসাদরের বুটে মাল ঢুকিয়ে আমি হরি বাবুর সাথে হিসাব সারছি। রশিদ বানিয়ে দেবার সময়ে বললেন – ” আশা করি আপনাদের বাকি যাত্রা শুভ হোক, আপনারা নিরাপদে ঘরে পউছান”। তার পর অল্প থেমে একবার আমার চোখের দিকে ধীর দৃশটিতে তাকিয়ে বাকিটা – “ছোট দিদিমণি বড় মিশটি – আপনারা ওকে সাম্লিয়ে রাখবেন, কারো নজর না লেগে জায়ে”। এ কথার কন জবাব দিতে পারলাম না। বাংলো থেকে বেরিয়ে গারিতে বাহাদুর সিঙ্গের পাশে বসলাম। গারি স্টার্ট দিল জলপাইগুড়ির পথে।

এই শেষ যাত্রাটুকু আমরা সকলেই চুপচাপ। পিছনে রুচিকা ওই বইটার মধ্যে ডুবে আছে। নীলা বাইরের রাস্তা দেখছে। গারি ঠিক জলপাইগুড়ি ঢোকার আগে নীলা পেছন থেকে বলল – “তুমি কি আবার সিগারেট খাওয়া শুরু করেছো ? তোমার কাল রাতের জামাতে ভীষণ চুরুটের গন্ধ পেলাম” ।

মাথাহীন লাশ



রাত হলেই শ্যামপুর গ্রামে সুনসান নিরবতা নেমে আসে- এই নীরবতার মাঝে থাকে শুধুই পাতার মর্মর আওয়াজ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। একটানা সেই ডাকে মোহনীয় হয়ে থাকে যেন কুসুমপুর গ্রাম।সুনসান নিরবতার এই গ্রামে আজ ও রাত নেমে এসেছে। কিন্তু প্রতিদিনের মত চুপচাপ নেই কেউ। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত যে কৃষক সে ও এসে ভিড় করেছে কালনীর শাখা নদী সুলিনার তীরে। ব্যাপার কিছুই না- সেখানে ভেসে উঠেছে এক মহিলার লাশ।

সবাই যে যার মত বলাবলি করছে, চিনতে চেষ্টা করছে লাশটাকে- কিন্তু কেউ চিনতে পারছেনা। কারন কেউ এই মহিলাকে খুন করে মাথাটা কেটে ফেলেছে। এখন চারদিকে লোক পাঠানো হয়েছে মাথার খোঁজে। মাথা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এই লাশ দাফন করার জন্য কেউ এগোচ্ছেনা । এর মাঝেই কোন কোন উতসুক জনতা গিয়ে দূর থেকে কাঠি দিয়ে লাশের হাত পা দেখার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু কোন ফলাফল নেই। হাতে পায়ে কোন চিহ্ন নেই- যে লাশটাকে চেনা যায়। রাত যত বাড়তে থাকে –তত ভীর বাড়তে থাকে। মাঝে ভীরের চাপ কমে গিয়েছিল। কিন্তু হটাত করে শোনা যায় শেখের বাড়ির সুলেখা কে পাওয়া যাচ্ছেনা। ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করে ঘর থেকে রেগে মেগে বের হয়ে গিয়েছিল সুলেখা। তারপর থেকে ওর পাত্তা নাই। সৎ মা ও সুলেখার কোন খোঁজ করেনাই। এখন ও সুলেখার মায়ের কোন দেখা নাই। শুধু ওর বড় ভাই জমির শেখ এর কান্না কাটি চলছে লাশটার পাশে। অনেকেই ওকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে- কিন্তু পারছেনা। বার বার আছাড় খেয়ে খেয়ে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে জামাল শেখ। ছোট বোন টাকে অনেক ভালবাসত সে। সকালে ঝগড়া হবার সময় বলেছিল-

“যা- দূরে যাইয়া মর গা” এখন সেই কথা শুনিয়ে বলতে বলতে চিৎকার করে কেঁদে উঠল ও। কিন্তু লাশের পরিচয় পাওয়া গেলনা। এর মাঝেই গ্রামের তিন জন মুরুব্বি এসে নিজেদের মাঝে বাহাস করতে লাগল। কেউ এই লাশ দাফন করতে চায়- কেউ নিয়ে ফেলতে চায় সেই পানিতে- যেখান থেকে ভেসে এসেছে লাশ। কেউ কেউ জানাজা পড়ার জন্যই বসে থাকল। কিন্তু লাশের পরিচয় পাওয়া গেলনা।

এর মাঝেই একটা চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে গেল সেই চিৎকারের উৎসের দিকে। সেখানে এক ১২-১৩ বছরের ছেলে মাটিতে হোঁচট খেয়ে ঊল্টে পড়ে আছে। কিন্তু চিৎকার করেছে ভয়ে। কারন সে যে জিনিস টার সাথে হোঁচট খেয়েছে সেটা আর কিছু না – সেই বেওয়ারিশ লাশের মাথা।মাটিতে সামান্য গর্ত করে কেউ ঢুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু মাটি আলগা হওয়াতে তাতে হোঁচট খেয়েছে ছেলেটা।

এরপর পরই ওঠে কান্না কাটির রোল। সুলেখার নাকের ফুল দেখেই সবাই চিনে ফেলে এটা সুলেখার লাশ। সাথে সাথেই দুই তিন জন মিলে সেই লাশের মাথা নিয়ে এসে লাশের পাশে রাখে। মরা কান্না জুড়ে দেয় জামাল শেখ আর তার আত্মীয় স্বজন রা।

গ্রামের মাতব্বর দের মাঝে দুই-তিনজন এই লাশের জানাজা করে দাফন করতে চায়না।চার পাঁচ জন তাদের সাথে কোরান-হাদিস নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ওই গ্রামের মসজিদের মওলানার সাথে তর্ক লেগে যায় করিম মওলা আর তার ছেলে রহমান মওলার । শেষে কোন মিমাংসা করতে না পেরে সেই লাশ দুই তিন জন মিলে কোন রকম জানাজা পড়ে দাফন করে। এর মাঝে গ্রামের হেডমাষ্টার সবুজ মিয়া ও ছিল। সবুজ মিয়া নিজের দায় থেকে এই কাজে উৎসাহ দেবার জন্য দোষি সাব্যস্থ হয় পরদিন এক সালিশে। দিন সাতেক সবার মুখে মুখে এই ঘটনা একের পর এক ডানা মেলতে থাকে। কেউ কেউ বলা শুরু করে সবুজ মিয়া এই সুলেখার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আর এর রেশ ধরে কয়েকদিন পর আবার সালিস ডাকা হয়। যেই তিন জন লাশ দাফন ও জানাজা করতে চায়নি তাদের রায়ে সবুজ মিয়া কে এক ঘরে করে রাখে সবাই। আসলে ওই তিন জন খুব ক্ষমতা শালী বলে কেউ ওদের মুখে মুখে তর্ক করতে চায়নি।তাদের মাঝে রহমান মওলা পরের মাসে চেয়ারম্যান পদে ভোটে দাড়াচ্ছে। তাই তার সাথে কেউ কথা কাটাকাটি করতে চায়নি।ফলাফল নিরিহ সবুজ মিয়াকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে সবাই। কিন্তু সুলেখার ভাই জামাল শেখের বন্ধুত্ব ছিল।তাই সবুজ মিয়াকে নিজের ঘরে খাওয়াতে শুরু করে সে। এর মাঝে সবাই সুলেখার কথা প্রায় ভুলে যায়।

দুই সপ্তাহ পর একদিন গ্রামের মসজিদের ইমাম ইসমাইল মিয়া ফজরের নামাজের আজান দিয়ে গিয়ে এক বীভৎস দৃশ্য দেখে ভয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সকালে সবাই তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় মসজিদে খুঁজে পায়। কেউ বলতে পারছেনা কেন সে অজ্ঞান হয়েছে। অনেক ক্ষন পর তার জ্ঞান ফিরলে সে সবাইকে নিয়ে যায় সুলেখার লাশ যেখানে দাফন করা হয়েছিল সেখানে। সুলেখার লাশের পাশে একটা জারুল গাছ আছে – সেখানে একটা ডালে পাওয়া যায় করিম মওলার ছিন্ন ভিন্ন লাশ। প্রথমে কেউ চিনতে পারেনি। কিন্তু গাছের গোড়ায় কে যেন লাশের মাথাটা সযত্নে কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে।

দৃশ্যটা দেখে অনেকেই সহ্য করতে পারেনি। শেষে পুলিশ দেকে পাঠানো হয়। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায় ময়না তদন্তের জন্য। এর মাঝে রহমান মওলা ক্ষেপে যায় নিজের পিতার এই অবস্থা দেখে। বিকেল যেতে না যেতেই সবুজ মিয়ার বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয় সে। সবাইকে বলে বেড়াতে থাকে যে সবুজ মিয়ে গুন্ডা লাগিয়ে তার বাবাকে হত্যা করিয়েছে। এই সময় তার সাঙ্গ পাংগরা মিলে সবুজ মিয়াকে গাছের সাথে বেধে ইচ্ছা মত মারতে থাকে। শেষে মার খেয়ে সবুজ মিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে ওকে নিয়ে স্কুল ঘরের একটা রুমে বেধে রাখে। সবাই গোপনে সুলেখার ভুতের কথা বললেও রহমান মওলার সামনে কেউ তর্ক করেনি মার খাবার ভয়ে। এর পর থেকে দুইদিন ধরে বন্দি থাকে সবুজ মিয়ে সেই স্কুল ঘরে। সকাল বেলা এসে রহমান মিয়ার লোক খাবার দিয়ে যায়। সবুজ মিয়ের খাওইয়া শেষ হলেই মার শুরু হয়। শেষে অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে দড়ি বেধে রেখে যায় রহমান মওলার লোকজন।

এর তিন দিন পরেই আবার শ্যামপুর গ্রামে শোর গোল ঊঠে। এবার ভোর সকালে পাওয়া যায় রহমান মওলার মাথা কাটা লাশ। মাথা কাটা লাশ গ্রাম বাসি দুইটা দেখেছে। কিন্তু এই রহমান মওলার লাশের পায়ের দিকটা ছিলনা। পাশেই পড়েছিল হাড় গোড়। যেন কেউ এসে খেয়ে গেছে লাশটাকে। এবার পুলিশ এসে সবাইকে জেরা করতে শুরু করে। এবং গ্রামের বেশ কয়েকজন লোকজন পালিয়ে যায় ভয়ে। কিন্তু পুলিশকে রহমান এর ভাই রহিম মওলা টাকা খাইয়ে বিদায় করে দেয়। গ্রাম বাসি স্বস্তি পেলেও ভয়ে বাড়ি থেকে দিনের বেলা ও লোকজন বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। সবুজ মিয়াকে নির্যাতন বন্ধ করা হয়- কিন্তু তাকে বন্দি করেই রাখা হয় সেই স্কুল ঘরে।

এর সাত দিন পরেই পর পর দুই জন লোকের লাশ পাওয়া যায় মাথা কাটা অবস্থায়। এই দুই জন হল গ্রামের সেই দুই মুরুব্বি যারা সুলেখার লাশ দাফনে বাঁধা দিয়েছিল। যারা সুলেখার জানাজা পড়তে চায়নি।গ্রাম বাসি এরপর প্রায় চুপচাপ হয়ে যায়। যারা সেই রাতে মুরুব্বি দের সাথে গলা মিলিয়েছিল তারা দুরের গ্রামে পালিয়ে যায়। এর মাঝে পুলিশ এসে দুইবার সবাইকে জিজ্ঞাসা বাদ করে। কিন্তু খুনি ধরা পড়েনা।

এর ঠিক দুই দিন পরে অমাবস্যা রাতে রহিম মওলা শুয়ে আছে ওর ঘরের খাটে। এই কয়দিনের মাঝেই সে নিজের প্রতিপত্তি প্রকাশে এলাকাতে টহল দিতে শুরু করেছে। মোটর সাইকেল নিয়ে এলাকার চ্যাংড়া ছেলে পেলেদের সাথে ঘুরে ঘুরে নিজেকে বাপ ভাইয়ের যোগ্য উত্তর সুরি হিসেবে জানান দিয়েছে। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে অনেক বেশি ক্লান্ত ছিল রহিম মওলা।পাশের মকবুল বুড়ার একটা খাসি জবাই করে খেয়ে দেয়ে শান্তির একটা ঘুম দিয়েছে সে। প্রতিদিনের চেয়ে এই অমাবস্যার রাত ছিল বেশি সুনসান। রহিম মওলা গভীর ঘুমে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে। গুনে গুনে তিনটা টোকার শব্দ হয়। আর তাতেই রহিম মওলা জেগে উঠে।কিন্তু দরজা খুলে হতভম্ভ হয়ে পড়ে সে।দেখে তার সামনে দাড়িয়ে ছিল একটা লাশ।দেখেই ভয়ে হতভম্ভ হয়ে যায় রহিম। কিছু বুজে ঊঠার আগেই সেই লাশের ডান হাত তার মাথার ঊপর উঠে আসে। এবং জ্ঞান হারায় রহিম মওলা।
জ্ঞান ফিরেই একটা কুয়াশাচ্ছন্ন এলাকার আবিষ্কার করে রহিম মওলা নিজেকে। চারদিকে ঘন কুয়াশার মাঝে কয়েকবার নিজের বন্ধুদের নাম ধরে ডাক দেয়। কিন্তু কেউ সাড়া দেয়না। মনে করেছিল ওর সাঙ্গ পাংগ দের কেউ ওর সাথে ফাজলামি করছে। চিৎকার করে বিশ্রী গালাগাল ও দিল কিছু। কিন্তু এরপর ই চার দিকে চারটা কাফনে জড়ানো লাশের অস্তিত্ব অনুভব করে সে। এবং একটু পড়েই চার দিক থেকে বেতের বাড়ি শুরু হয়ে যায়। প্রচন্ড সেই মার খেয়ে অজ্ঞান প্রায় রহিম মওলা- এমন সময় মার থেমে যায়। আসতে আসতে ঊঠে বসে সে। সামনে তাকিয়ে তার দৃষ্টি থেমে যায়।অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রহিম-কারন তার সামনে বসে আছে সুলেখা। দেখেই ভয়ে চিৎকার করতে ভুলে যায় সে। এমন সময় সুলেখা বলে উঠে-
“কি রে আমারে চিনতে পারসোস? আমি সুলেখা-এই যে দেখ আমার মাথা এহন ও কাডা”- বলেই নিজের মাথাটা দুই হাত দিয়ে একটানে খুলে রহিম মওলার সামনে ধরল। দেখেই বমি করে দিল রহিম মওলা। দুই হাত দিয়ে পেট চেপে একপ্রস্ত বমি করে রহিম মওলা বলল-
“আমারে ছাড়ি দেও- আমাক মাফ করি দেও সুলি আফা-আমাক মাফ করি দেও” বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল রহিম।
“কি? ছাড়ি দিমু? সেদিন কি আমাক ছাড়িছিলি রে তোরা দুই ভাই? আমি কতক করি কয়েছি আমাক ছাড়ি দে- তোরা আমার ছোট ভাই লাগস- নিজের বইন মনে করি ছাড়ি দে- কই সেদিন তো ছাড়িস নাই। আমাক দুই জন মিলি নষ্ট করলি। তারপর আমাক যাতে কেউ চিনতে না পারে – তুই –তুই মওলার বাচ্চা আমার মাথা কাটি ফালালি। আমার সবুজ মিয়ারে কতক মারলি তোরা- কই সেদিন মনে আছিল না? মনে আছিল না আমার কথা?” বলেই নিজের মাথাটা আবার নিজের ধরে জোড়া লাগাল সুলেখা।
এবার কেদেই ফেলল রহিম-বলল-“আফা ভুল হইয়ে গেছে আফা- তুমি আমারে এবারের মত মাফ করি দেও আফা। আমি কইতাসি আমি এর পেরাচিত্ত করি ছাড়ুম”।
এবার খিল খিল করে হেসে ঊঠল সুলেখা –সেই হাসি শুনে কাঁপতে শুরু করে দিল রহিম মওলা। আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে আসছে সুলেখা। সামনে ভয়ার্ত রহিম মওলা। তারপর রহিমের ধরে একটানে ছিড়ে ফেলল তার মাথাটা- গলগল করে রক্ত পড়ছিল সেই কাটা মাথা থেকে। মাথাটা হাতে নিয়ে গা হিম করা একটা চিতকার দিয়ে কেঁদে উঠল সুলেখা।

এই ঘটনার কিছুক্ষন পর নিজের চোখে মুখে জলের ঝাপটা খেয়ে জেগে উঠল সবুজ মিয়া। সপ্তাহ খানেক ধরে এভাবেই তার ঘুম ভাঙ্গে। মওলা দের কেউ একজন চোখে মুখে পানি ঢেলে দেয়। তারপর খাওয়া দেয়। তার কিছু খায়- কিছু খায়না। তারপর শুরু হয় মার। আজকে তাই জেগে ও চোখ বন্ধ করে রেখেছিল সে। কিন্তু মাথায় একটা কোমল স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুলেখা।আসতে আসতে ঊঠে বসল সবুজ। শরীরে এতদিন না খাওয়ার ফলে শক্তি নাই। কিন্তু কেন যেন নিজের চোখকে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে তার। সে বলল- “ সুলেখা তুই?”
“হ আমি –মইরা গেছিলাম। আজকা আমার মুক্তি হইতাসে-তাই শেষ বার তোমারে দেখতে আইলাম” বলেই কেঁদে ফেলল সুলেখা।
“আমার বিশ্বাস হইতেসে না রে- তুই কেমনে মরলি রে?” চোখ বড় বড় করে বলল সবুজ মিয়া।
“এত শুইনে কোন লাভ নাই মাষ্টার। তুমি আসতে আসতে ঊঠ। নাও আমি তোমারে শেষ বারের মত খাওয়াই দিতাসি দুইটা ভাত’ – বলে পাশে রাখা থালা থেকে ভাত খাইয়ে দিল সুলেখা সবুজ কে। সবুজ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা। কোন কিছুর সাথে কোন কিছু মেলাতে মেলাতে ক্লান্ত হয়ে শেষে ভাত খেতে শুরু করল মন্ত্রমুগ্ধের মত। খাওয়া শেষে সুলেখা বলল-
“আমি যাই মাষ্টার- তুমি কয়দিন পর সুন্দর দেইখে একটা নিকা কইরো। আমাকে ভুলি যাইও মাষ্টার” –বলেই পা বাড়াল সুলেখা।

এতক্ষন ঘোরের মাঝে থাক্লেও এখন জ্ঞান ফিরে আসে সবুজ মিয়ার। দৌড় দেয় দরজার দিকে। দরজা খোলাই ছিল। খুলে দেখে ভোর হয়ে গেছে। সূর্য প্রায় ঊঠে গেছে।আর সেই সূর্যের দিকে আসতে আসতে এগিয়ে চলেছে সুলেখা।কিন্তু সবুজ আর দৌড়ায়নি সুলেখার পেছন পেছন- কারন সুলেখা এগিয়ে চলেছিল তার শেষ ঠিকানা সেই কবরের দিকে…

একটি পিশাচ গল্প


ঘটনাটা বরিশালের ,বাউফল থানার
মুলাদি গ্রামের!
ঘটনাটা ৪০বছর আগের!
আমার এক নিকট আত্বীয়ের ঘটনা ও
তারকাছ
থেকে শোনা! তার ভাষায়!
আমার বয়স তখন ২২বছর !
আমার বাবার খুবই
ডায়রিয়া হয়েছিল!গ্রামের
এক
কবিরাজকে দেখিয়েছি এবং সে বলে না’যত তারাতারি সম্ভভ
শহরে নিয়ে ভাল
ডাক্তার দেখাতে!কারন তখনকার
দিনে গ্রামের দিকে কোন ডাক্তার
ছিল না!
আর শহর ২৫কিঃ মিঃ দূরে! শহরে যেতে হবে নৌকায়করে!
যোগাযোগে একমাএ উপায় ছিল
নদীপথ! ভাল
রাস্তা তখন ছিল না!
বাবাকে নিয়ে যখন
রওনা করি তখন বেলা ১২ বাজে! প্রথমে আকাবাকা ছোট খাল
পেরিয়ে বড়
নদী ও তার ঐ পাড়ে শহর!
শহরে পৌছাতে আরো ঘন্টা আডাঁই
লেগেছে!
বিকাল ৫টার দিকে বাবা মারা যায়! বাবার
লাশটা নিয়ে আমি আবারবাড়ির
দিকে রওনা দেই!বড় নদীটা যখন
পার
করে খালের দিকে নৌকাঢূকাই তখন
দেখতে পাই নৌকা আর চলছে না’কাঁদায়
আটকে গিয়েছে!
তখন ভাটা চলছে! জোয়ার আসবে রাত
১২টার
দিকে!তখন সময়টা আনুমানিক
সন্ধা সাডে ৬টা হবে! শীতেরকাল থাকায় ঐ
সময়ে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল
চারপাশ!
আকাশের জোত্নার আলো ছিল খুব!
জনমানব
শূন্ন একটি স্থানে এসে নৌকাটা আর চলছে না! খালটার বামপাশে একটু
দূরে একটি পরিতেক্ত শ্বশান আর
ডানপাশে গভীর জঙ্গল!জঙ্গলের
বটগাছ
গুলে দানবের মত দাড়িয়ে আছে!
বটগাছের ডালে কিছু বাদুরঝুলে আছে!এতটাই
নির্জন
জায়গায় যে কোন শব্দ হলেই বুকের
ভিতরে কেমন যেন করে ওঠে!ভয়ে
বাবার লাশটা স্পর্শ করে বাবার
পাশে বসে থাকি!শুধু অপেহ্মা ছাড়া আর কোন
উপায় নেই! একটা চাদর
দিয়ে বাবার
লাসটা ঢেকেদিয়েছি!রাত যত
বাডতে থাকে ভয়
ততটাইতীর্বরোহতে থাকে! মনে হয় জঙ্গল থেকে কিছু
একটা বেডিয়
এসে আমাকে ধরবে ! হটাত্
নৌকাটা কেমন
যেন একটু দুলে উঠলে মনে হল আমার
মৃতবাবা নাডে উঠছে! বাবার ঠান্ডা শরির
থেকে হাতটা সরিয়ে নেই!
দোয়া যতটুকুপাড়ি সবই
পড়তে চেষ্টা করছি কিন্ত
ভয়ে কিছুই
মনে নেই! ইচ্ছা করছিল চিত্কার করি বাচাঁও
বাচাঁও বলে!কিন্তু আমি জানি আমার
এই
চিত্কার কারো কানে পৌছাবেনা!
না পারছি এখান
থেকে যেতে,না পারছি থাকতে! নিজের
মৃতবাবাকেও ভয় করছে!
আনুমানিক রাত ১১টার
দিকে একটা ছায়া দেখতে পেলাম
বট গাছের
অড়াল থেকে বেডিয়ে আমাদের নৌকার
কাছে আসলো ও
আমাকে জিঙ্গাসা করলো’তুমি কিঐ
দিকে যাবা ?লোকটি একটা চাদর
গায়ে জড়িয়ে আছে ও তার
মুখটা চাদরে ডাকা ছিল! লোকটি ইশারায়
যে দিকে দেখালো ঐ দিকেই
আমরা যাচ্ছি!
লোকটিকে বললাম জোয়ার
আসলে যাব!
লোকটি নৌকায় উঠলো ও বাবার কাছে বসলো কিন্তু বাবার
সম্পর্কে কিছুই
জিঙ্গাসা করলো না!
একদৃষ্টিতে বাবার
লাশটার দিকে চেয়ে ছিল!
লোকটার মুখটা আমি তখনো দেখতেপাই নি!
এই গহীনজঙ্গলে এতরাতে তার
আগমনের
কারনটা পর্যন্তে জানতে ইচ্ছা করে
আগমনে শস্তি পেয়েছি!
রাত ১২টার দিকে জোয়ার আসলে আমি নৌকাটা চালাতেশুরু
করি!
নৌকাযত সামনের দিকে যাচ্ছে ততই
একটা গন্ধ নাকে লাগছে!
ধিরে ধিরে গন্ধের
তীবরোতা বাড়তে থাকে!কিছু কচুরিপনা ,
কলাগাছ ও মরা একটাগরুর
ফুলে থাকা দেহ
একসাথে জটলা করে এমনভাবে নৌকা
সাথে আটকে আছে যে আমি অনেক
চেষ্টা করে ও নৌকাটাকে কিছুতেই সামনের
দিকে নিতে পারছিনা!
বাদধো হয়ে আমি নৌকা থেকে পানিত
রশি ধরে টানতে থাকলাম !প্রায় ৫
মিনিট
টানার পর আমি নৌকার কাছে আসি ! তখন
যা দেখলাম বুকের ভিতর কেমন যেন
করে উঠলো!দেখি লোকটাবাবার
বুকেরকাছে বসে বারার বুকের ভিতর
হাত
ঢুকিয়ে দিয়ে কলজাটা বেরকরে নিয় তখন আমি কোন উপায়
না দেখে বৈঠাটা হাতেনিয়ে লোকট
মাথায়
আঘাতকরি একাধিক বার!
লোকটা আমার
দিকে যখন ঘুড়ে তখন ঠিক গলার মাঝখানে বৈঠাটা ঢুকিয়ে দেই !
এতে লোকটা পানিতে পড়ে যায়!
আমি পানিতে খুব
জোরে জোরে বৈঠাদিয়ে আঘাত
করি ও
চিত্কার করি সাহষ থাকলে সামনে আয়!চাঁদের
আলোতে লোকটার রক্তমাখা লোমশ
হাতটা দেখেছিলাম !বড়বড় নখ ও
কোঠরে ঢোকানো চোখের নীল
আভা মনে পড়লে বুকটা শুকিয়ে যায়!
দাতগুলো লালচে খুব ছোট ছোট তীখ্ন আর
ধারালো!
আমার চিত্কার শুনে টর্চলাইট
নিয়ে কয়েকজন
লোক ছুটে আসে তাদের সব কিছু
খুলে বলি ! সব কিছু শুনে তারা বাবার
লাশটা দেখে’তখন
ও বাবার বুকের ছোপ ছোপ
রক্তগুলো শুকায়নি!
ঐ রাতটা ছিল আমার জীবনের
সবচেয়ে ভয়ংকর রাত!যেরাতের কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না!
ঐটা ছিল একটা পিশাচ !

মাংশ পিন্ড


আমার মেঝো কাকা ছোটবেলা থেকেই ভীষণ জেদি আর একরোখা ছিলেন। দাদুর নির্দেশ অমান্য করে রাত বিরাতে গ্রামের বন্ধুবান্ধবের সাথে চলে যেতেন দূরে যাত্রা দেখতে অথবা মাছ শিকারে। প্রথমেই বলে নেই, গ্রামে গঞ্জে রাতে মাছ ধরার অন্যতম কারন হল, তখন মাছ ধরা পড়ে বেশি। তাই মানুষ বেশিরভাগ সময়ই রাত হলে মাছ ধরতে যায়। এমনি ভাবে একদিন আমার কাকা তার কয়েক বন্ধুর সাথে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে প্রায় ২ মাইল দূরের একটা ঝিলে। ঐ ঝিলে প্রচুর শাপলা ফুটতো। আর ঝিলটি নাকি গভিরতায় অনেক বেশি ছিল। তাই সাধারণত মানুষ খুব একটা যেত না সেখানে মাছ মারার জন্য। ঐ ঝিল নিয়ে অনেক খারাপ কথা ছড়িয়ে আছে গ্রাম জুড়ে। প্রায় প্রতি বছরই ৩-৪ জন মানুষ ঐ ঝিলে ডুবে মারা যায়। তাদের মাঝে অনেকেই ভালো সাঁতারু ছিলেন। তো, এসব কথা জানত বলে দাদা দাদু মানা করলো যাওয়ার জন্য। কিন্তু কাকা জেদ ধরলেন যে তার যেতেই হবে। ভয়ে সরে গেছেন ভেবে পড়ে তার বন্ধুরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে এটা কাকা মেনে নিতে পারছিলেন না। যাই হোক, উনারা খুব আয়োজন করে ৪ বন্ধু মিলে গেলেন মাছ ধরতে। কাকা এবং উনার বন্ধু কাশেম লুঙ্গী কাছা দিয়ে প্রায় কোমর পানিতে নেমে গেছেন। উদ্দেশ্য ছিল একটু গভীরে গিয়ে জাল মারা। একটু বলে নেই, সেদিন আমাবস্যা ছিল। তেমন আলো ছিল না চারপাশে। তাই উনারা একটা হ্যাজাক বাতি নিয়ে গিয়েছিলেন। যাই হোক, উনারা জাল মেরে ঠিকঠাক ভাবেই উঠে এলেন। উপরে যেই দুজন ছিলেন তারা অপেক্ষায় ছিলেন। আস্তে আস্তে জাল গুটাতে লাগলেন। কাকারাও এর মাঝে ঝিল থেকে উঠে পড়েছেন। ৪জন মিলেই ঝিলের পারে দাঁড়িয়ে জাল গুটাচ্ছিলেন। হটাত কিসের যেনও আওয়াজ হল পেছন থেকে। কে যেনও ধমক দিল মনে হয়। হ্যাজাকের আলো ছিল, সেই আলোতে পেছনে ঘুরে দেখলেন উনারা। কাউকে দেখলেন না। ভাবলেন হয়তো মনে ভুল। আবারো জাল টানতে লাগলেন।
হটাত কি যেনও হল, উনাদের হাত থেকে জালের দড়ি খুব দ্রুত সরে যেতে লাগলো। মনে হতে লাগলো কে যেনও খুব শক্তি দিয়ে উনাদের হাত থেকে সেই জালটা ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। চারজন শক্ত সামর্থ্য জওয়ান, এদের হাত থেকে জাল টেনে নিয়ে যাওয়ার মত কোনও মাছ সেই ঝিলে ছিল না। কাকারা প্রান প্রন চেষ্টা করতে লাগলেন জালটা থামানোর জন্য। তাল সামলাতে না পেরে কাকার এক বন্ধু পা পিছলে পড়ে গেলেন। পড়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হরহর করে গভীর পানির দিকে তলিয়ে যেতে লাগলেন। মনে হতে লাগলো, কেউ যেনও তার পা ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কাকারা বিস্ফোরিত চোখে তা দেখতে লাগলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কাকার সেই বন্ধু বার বার পানির নিচে ডুবে যান আর যখনই মাথা উপরে উঠে তখনই চিৎকার করে সাহায্য করতে বলেন। কাকার বন্ধুরা হই হই করে পিছনের দিকে চলে যেতে লাগলেন। তারা ঝিল থেকে উপরে উঠে মাটির রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। কিন্তু কাকার মনে হয় বুদ্ধি জ্ঞান লোপ পেয়েছিল। উনি বিমুরের মত সামনে, আর গভীর পানির দিকে যেতে লাগলেন। পেছন থেকে কাকার বন্ধুরা চিৎকার করছিলো, যাসনে, যাসনে করে। কিন্তু কাকা উনাদের কথা না শুনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হটাত কাকা আবিষ্কার করলেন উনার পায়ের নিচ থেকে মাটিগুলো যেনও ধপ করে সরে গেলো। দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলেন, কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যে পানিতে ডুবে গেলেন কাকা। হটাত অনুভব করলেন কে যেনও পানির নিচে টানছে তাকে। খুব শক্তি তার প্রতিপক্ষের। একে তো পানির নিচে, তার উপর টান সামলাতে পারলেন না কাকা। ডুবতে লাগলেন। নাক দিয়ে পানি ঢুকতে লাগলো। ফুসফুসের জমা করা বাতাস গুলো বুদ বুদের মত করে বেরিয়ে গেলো চিৎকারের সাথে। যেহেতু পানির নিচে তাই কোনও আওয়াজ হল না। আস্তে আস্তে দমে যেতে লাগলেন কাকা। শেষবারের চেষ্টার মত সরব শক্তি দিয়ে লাথি মারলেন নিচের দিকে।
অনুভব করলেন কিছু একটার গায়ে ঠেকল পা টা। অনেকটা মানুষের শরীরের মত লাগলো। কাকার মনে হল হয়তো পানির নিচে কেউ আছে যে তাকে নিচ থেকে টানছে। নিজেকে বাঁচানোর একটা তাগিদ ফিরে এলো। যদি পানির নিচের মানুষটার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায় তাহলে হয়তো বেচে যাবেন। নিজের সব শক্তি এক করে একটু ঝুঁকলেন কাকা। নিজের পায়ের কাছে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে আঘাত করতে লাগলেন। এলোপাথাড়ি কয়েকটা আঘাতের পর একটা গিয়ে লাগলো কারো মাংশ পেশিতে। কাকার এক পা থেকে বাঁধন ছুটে গেলো। এবার কাকা দিগুন উদ্যমে আবারো হাত চালালেন, কয়েকটা মারার পো মনে হতে লাগলো হয়তো এ যাত্রা বাঁচবেন না, ঠিক তখনই আর একটা ঘুষি গিয়ে লাগলো সেই মাংশ পিণ্ডে। দ্বিতীয় পাটাও মুক্ত হলে এবার। টর্নেডোর গতিতে উপরে উঠতে লাগলেন কাকা। উনার হাতটা শরীরের পাশে ছিল। হটাত হাতে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলেন কাকা। মনে হল কে যেনও ধারালো কিছু বসিয়ে দিলো উনার হাতে। কোনমতে উপরে উঠলেন কাকা। উপরে উনার বুন্ধুরা বন্ধুর বিপদ দেখে ঝুঁকি নিয়েই ঝিলে নেমে পড়েছিলেন। কাকাকে দেখেই উনাকে টেনে নিয়ে চললেন রাস্তার দিকে। জ্ঞান হারালেন কাকা।
পরদিন সকালে কাকার জ্ঞান ফিরে আসে। এরপর একটানা ২৬ দিন উনি জ্বরে ভুগেন। এরপর আস্তে আস্তে সুস্থ হতে থাকেন।
ওহ, কাকার সেই বন্ধুটিকে পরে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। ঝিলটি আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কোথাও পায়নি গ্রামের লোকেরা।
আমার কাকার হাতের সেই তীব্র ব্যাথাটি কিসের ছিল জানা যায়নি। তবে মানুষ কামর দিলে যেমন হয় তেমন একটা দাগ পরে যায় কাকার হাতে। সেই হাত তিনি আর ব্যাবহার করতে পারেননি পরে। এমনকি এখন পর্যন্ত উনি হাতটা নাড়তে পারেন না।

এক যুবকের লাশ


মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলায় পুখুরিয়া এলাকায় একবার অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার
করে পুলিশ। সেই লাশটির কোনও নাম পরিচয় পাওয়া না যাওয়ায় তকে বেওয়ারিশ লাশ
হিসেবে দাফন করা হয়। পরদিন সকালে স্থানীয় কয়েকজন কবরটির উপরের মাটি সরে
থাকতে দেখে এলাকার পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে তাদের লোক নিয়ে কবর খুঁড়ে দেখে
কবরটি ফাঁকা, এবং সেখানে শুধু কাফনের কাপড় পড়ে আছে।

এই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় মানুষের অনেক গরু ছাগল খুব দ্রুত কোনও কারণ ছাড়াই মারা
যেতে লাগলো। এমন অদ্ভুত রোগ কেউ কখনো দেখে নি। তাদের গরু বা ছাগলগুলো খোওয়ারে
মরে থাকতো এবং গাঁয়ে কোনও রক্ত থাকতো না।

কেউ যেনও রক্ত চুষে নিয়েছে সেগুলোর গা থেকে। ভয়ে অনেক গৃহস্থ সেই এলাকায় গরু
ছাগলগুলো বিক্রি করে দেয়। এলাকার স্থানীয় কৃষক, বাচ্চু মিয়াঁ একবার নিজের খোওয়াড়ে
অদ্ভুত শব্দ পেয়ে উঁকি দেন। তখন সন্ধ্যা মাত্র হয়েছে। তাই ফাঁকফোকর দিয়ে খোওয়াড়ে
আলো পড়ছে খানিকটা। সেই আলোতে তিনি দেখলেন তার একটা গরু মরে পড়ে আছে এবং তার
উপর এক অদ্ভুত মানুষসদৃশ প্রাণী চেপে বসে আছে।

সেই প্রাণীটি ঐ গরুর গলায় কামড় দিয়ে ধরে যেনও রক্ত খাচ্ছে। ভয়ে বাচ্চু মিয়াঁর গলা
দিয়ে আঁতকে উঠার শব্দ বের হয়। সাথে সাথে ঐ বস্তুটি বাচ্চু মিয়াঁর দিকে চোখ তুলে
তাকায়। খানিকটা অন্ধকারেও সেই বস্তুর চোখ থেকে নীল আলোর মতো বের হচ্ছিল। এরপর
তা খুব দ্রুত খোওয়াড়ের পাশে জানালা দিয়ে বের হয়ে পাশের ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
বাচ্চু মিয়াঁর ভাষ্যমতে, ঐ বস্তু মানুষের মতই দৌড়চ্ছিল। তবে খুব দ্রুত। প্রায় চোখের
পলকে হারিয়ে যায় বস্তুটি। ঐদিনের পর থেকে ঐ গ্রামে আর কোনও গৃহপালিত পশু মরার
কথা শোনা যায় নি।